শুক্রবার, ৭ অক্টোবর, ২০১১

তান্ত্রিক গ্রন্থে বাঙালা লিপি (এক)




প্রাচীন বাঙলা লিপির প্রতিটি বর্ণের একটি চমৎকার বর্ণনা আমরা খুজে পেয়েছি 'বর্ণোদ্ধার তন্ত্র' ও 'কামধেনু তন্ত্র' নামক দু'খানি গ্রন্থে। যদিও সেখানে বাঙালা লিপি কথাটার সরাসরি উল্লেখ নেই। কিন্তু বর্ণনা ভঙ্গি ও অক্ষরের আকৃতি রূপায়ণে তা বাঙালা লিপি বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকগণ।
বই দুটিতে 'প্রাণ-তোষিণী' নামক তন্ত্রের ভিত্তিতে বিবৃত নামোল্লেখহীন লিপির 'স্বর' ও 'ব্যঞ্জন বর্ণে'র ধর্মীয় মহিমা, আকারগত বিবরণ এবং 'বাঙালা' ও অন্যান্য পার্শ্ববর্তী প্রাচীন লিপির সঙ্গে তুলনা কি রকম হতে পারে তা আমরা দেখতে পারি।

এক.
স্বরবর্ণ

১. ক. কামধেনুতন্ত্রে (প্রথম পটলে)- 'অ'

'হে বরাননে! অ-কারের অতি গোপনীয় তত্ত্ব শোন। শরৎকালের চাঁদের মতো (এ বর্ণ) সর্বদাই পঞ্চকোণময়। পঞ্চদেবময় (এ বর্ণ) শক্তি সমন্বিত। স্বয়ং কৈবল্যমূর্তির অনুরূপ (এ বর্ণ) সগুণ ও নির্গুণযুকাত। দ্বিবিন্দুযুক্ত (এ বর্ণ) নিজেই প্রকৃতি রূপিনী।'

অর্থ- ওহে সুন্দর মুখবিশিষ্ট্যা(দূর্গা, উমা দেবী)! বাঙলা - অক্ষরের গোপন দর্শন/কথা শোন। বাংলা ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরৎকালে যে পূর্ণ চাঁদ ওঠে, সেটার মত "অ" অক্ষরটি সব সময় পাঁচকোনা বিশিষ্ট। পাঁচ দেবতা(দূর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, গণেশ) শক্তি এর মধ্যে নিহিত। এটা নিজেই শিব মুর্তির মত, এতে গুণ যেমন আছে, আবার তা নেইও। এই অক্ষরে দুটো বিন্দু বা পুটলি আছে, এজন্য এটা প্রকৃতি(দেবী) রূপ সাদৃশ্য।
এটা আমার ব্যক্তিগত অনুবাদ। কেউ এটা সম্পর্কে আরো যথাযথ অনুবাদ থাকলে দিতে পারেন।


খ. বর্ণোদ্ধারতন্ত্র- 'অ'

'ডান দিকে কোঁকড়ানো (ও) বাঁকানো এবং বাম দিকে প্রসারিত; তার উপরে যুক্ত রেখা। ডাইনে, উপরে শংকর (অবস্থিত)। বিধি নারায়ণ ও তথায় ক্রমানুসারে স্থিত। অর্ধমাত্রা, শক্তির ধানস্থ রূপ বলে কথিত ।।অ।।


অর্থ- এই 'অ' অক্ষরের ডানদিকে কোঁকড়ানো(গোলায়িত) আর বাঁকানো এবং বাম অংশ প্রসারিত। অক্ষরটির উপরে একটি মাত্রা আছে যা অক্ষরের সাথে মিলানো। ডাইনে, উপরের দিকে পেঁচানো চন্দ্রবিন্দুর মত শিব চিহ্ন আছে(প্রাচীনকালে এরকম ছিল, এখন নেই)। শিবের নিয়ম অনুযায়ী তা যথাস্থানে রাখা হয়েছে। তবে এর উপরের মাত্রাটি অর্ধেক হবে, যেটা শক্তি অর্থাৎ শিবের ধ্যানমগ্ন রূপ বলে প্রকাশ করা হয়েছে।
এটাও আমার ব্যক্তিগত অনুবাদ। কারো কাছে এটা সম্পর্কে আরো যথাযথ অনুবাদ থাকলে দিতে পারেন।
বর্ণনা-অনুসারে-

অ- হল, ডান দিকে কোঁকড়ানো ও বাঁকানো এবং বামদিকে প্রসারিত। অর্ধ্বমাত্রাযুক্ত (এ বর্ণ)।





তুলনা-

এ রকম অ, বর্ণ নাগরী লিপিতে নেই। নাগরী অ-এর 'কুণ্ডলী' বাম দিকে। তবে মাত্রা অর্ধ্বই। নেওয়ারী লিপির অ-অনেকটা উক্ত বর্ণনা-অনুসারী। তবে চর্যাপদের প্রচীন অ, পঞ্চকোণ যুক্তই। একে দ্বিবিন্দুযুক্তও বলা চলে। কারণ এর মোড়া দু'টি।

[ভূতডামরের বক্তব্য অনুযায়ী শিব-মতে এ বর্ণের অধিপতি দেবতা- 'বিদ্যুৎজিহ্বা']










(এই চিত্র সমূহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুথি শালায় সংরক্ষিত 'শারদা তিলক' নামক লিপি থেকে গৃহীত। গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষায় বাঙালা অক্ষরে লেখা একখানি তান্ত্রিক পুথি। নম্বর-৪৬০৮।)

আজ এ পর্যন্ত। এরপর 'আ' বর্ণ নিয়ে কথা হবে।


সূত্র- বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)

বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১১

বাংলা গদ্যের পিতৃ পরিচয়





বাংলা ভাষার ইতিহাস বিষয়ক একটা বই পড়ছি। এতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপি নিয়ে যে ধারণা ছিল, এ বই পড়ে, তাতে সন্দেহ দানা বাধছে।

আমরা জেনে এসেছি, বাংলা গদ্যের পিতা হিসেবে পর্তুগীজ, ইংরেজ এবং পরে হিন্দুদের ভূমিকা এবং অবদান রয়েছে। মুসলমানরা শুধু পয়ার ছন্দে কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। তাও কোন সাহিত্যের মধ্যে পড়ে না। যদি মুসলমানদের এতে কোন অবদান থেকেই থাকে তা হচ্ছে বাঙলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করা। অর্থাত- বাঙলা ভাষার জন্য জন্য পয়সা খরচ করলেও এর পিতা তারা নন।

এখন পর্যন্ত আমাদের মুসলমান পন্ডিতগণ এ ইতিহাস কবুল এবং প্রচার করে চলেছেন।

কিন্তু কয়েকটি প্রশ্ন এখানে এসে পড়ে-

এক. মুসলমানদের এ অঞ্চলে শাসন করা ১০০০-১৭০০খৃ. পর্যন্ত বাঙলাহ মুলুকে কাদেরকে বাঙালী বলা হত?

দুই. আপার বাঙলা মুলুকের(গৌড় বা বঙ্গ) লেখক, কবি, সাহিত্যিকগণ নিজেদের কি বলে পরিচয় দিতেন এবং নিম্ন বাঙলা মুলুক বা বাঙ্গাল ভূমি বা পূর্ববঙ্গের লোকদের তারা কি বলে অভিহিত করতেন?

তিন. যে জন বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। কবি আবদুল হাকিম কেন এ কবিতা লিখেছেন??

চার. ১০০০-১৮০০খৃ. পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোন অবদান কি নেই?


কয়েকটা তথ্য-
এক.
বাঙলা মুলুকে মুসলমানদের শাসন কায়েম থাকা পর্যন্ত কোন অমুছলিম কবির রচনায় 'বাঙালী জাতি' 'বাঙালা দেশ' 'বাঙালা ভাষা' এই তিন জোড়া শব্দ খুজে পাওয়া যায় না। যদিও মুসলমান কবিদের রচনায় তার ভুরি ভুরি উল্লেখ আছে। তবে এরপর ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাঙলা মুলুকে এ শব্দগুলো যদিও অমুসলিম কবিরা ব্যবহার করেছেন, তবে তা তারা কোথাও সদর্থে লেখেননি।
'আপার বেঙ্গলে'র অমুসলিম কবিরা, তাদের দেশের নাম 'গৌড়'(পঞ্চ গৌড়, গৌড় মণ্ডল), জাতির নাম 'গৌড়াই'(গৌড়ী, গৌড়জন, গৌড়ের লোক, গৌড়িয়া ইত্যাদি) বলে উল্লেখ করেছেন। পক্ষান্তরে, তারা নিজ দেশের নাম 'বাঙালা', নিজ জাতির নাম 'বাঙালী' বা নিজ ভাষার নাম 'বাঙালা ভাষা' কখনও বলেননি; লেখেননি।

দুই.
দীনেশচন্দ্র সেন ১৮০৪ সাল পর্যন্ত কোন হিন্দু কবির রচনায় "বাঙালা ভাষা" নাম খুজে পাননি। আর তা না পেয়ে অবাক হয়ে ভেবেছেন- 'বাঙালা ভাষা', এই নামটা অতি আধুনিক।

তিন.
অমুসলিম কবিরা বাঙালা ভাষাকে লিখেছেন- 'ভাষা', 'পরাকৃত ভাষা', 'পয়ার', 'পাঁচালী'।

চার.
পরে বৃটিশ শাসনামলে এসে তারা লিখলেন-'দেশী ভাষা', 'সাধু ভাষা', 'বঙ্গ ভাষা', 'বাঙ্গলা ভাষা', 'বাঙ্গালা ভাষা', 'গোড়ীয় ভাষা' ইত্যাদি।

পাঁচ.
১৮৭২ সালে ঢাকা জেলার এক হিন্দু জমিদারের নাটমঞ্চে একটি সালিশ এবং তার রায় লেখা হয়েছিল। সেটা ছৈয়দ জালালদ্দিন আহমদ লিখেছিলেন, সালিশ মজলিসে হিন্দু-মুসলিম মিলে জনা পঁচিশ উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনা মৌলবী আবদুল আজিজ তার "ওয়ারেছ আম্বিয়া"(নামপত্র ছিন্ন) গ্রন্থে গদ্য বাংলায় লিপিবদ্ধ করেছেন। ঘটনাটিকে সেখানে 'মহফেল নামা' অধ্যায়ে লেখা হয়েছে।
এখানে সেই ঘটনার আংশিক উদ্ধৃত করা হল-


"এই মহফেল নামা লিখিবার কারন-এইসকল মোছলমান আপন-দিন(ধর্ম) আর মজহাবের উপর মজবুত থাকে। আরছুন্নত-জমাতের মজহাব ছাড়া সকল মজহাব হৈতে তফাত থাকে,-সন ১২৭৯ সন বাঙালা তারিখ ৩১ আসাড় রোজ রবিবার মুলফতগঞ্জ নিবাসী মৌলবি আবদুল আজিজ ছাহেব ও সোলই গোয়াল পাড়া নিবাসি জনাব মির বন্দে আলি সাহেব, এই দোন ছাহেবান একাজুক্ত হইয়া মোকাম লোং সিং শ্রীজুত বাবু গৌরচন্দ্র রায়বাহাদুর মহাশয়র বাটি, নাট মন্দিরে বৈঠক হইয়া তথায় উপকক্ত(উপর্যুক্ত) শ্রীজুত বাবু গৌরচন্দ্র রায়বাহাদুর মহাশয় ও নরিয়া নিবাসী শ্রীজুত হরিপ্রসাদ রায়ঘটক চৌধরি মহাসয় ও ইলিদপুর নিবাসী শ্রজুততিলক চন্দ্র রায়চৌধরি মহাশয়....ও জনাব হাফেজ মহাহ্মদ ফাজেল ছাহেব ও জনাব ছৈঅদ এহছানদ্দিন ছাহেব.... ওগয়রহ ঐ আতরাফের উত্তম২ লোগ সকলের সাক্ষ্যাতে বসিয়া জে জে মছলার আপসের মৈদ্দে এখতেলাপ ছিল, সেই সকল মছলার মৈদ্দে কয়েক মছলায় ঢাকার ফতওার মজমুন মোতাবেক জে জে কথা-কথন হইয়াছিল ও সালিস .....আমি এই মহফেল নামায় লিখিতেছি। ইতি-



ছয়.
'বাঙালা' গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে স্যার জর্জ গ্রীয়ার্সন লিখেছেন-
"When the advent of the English there arose a demand for prose literature, and the task of supplying it fell into the hands of sanskritridden pandits. Anything more monostrous than this prose dialect, as it existed the first half of the nineteenth century, it is difficult to conceive, books were written excellent in there subjects eloquent in their thoughts, but in a language from which something like ninety percent of the genuine Bengali vocabulary was excluded, and its place suppiled by words brrowed from sanskrit, which the writers themselves could not pronounce. During the past fifty years there has been a movement, without much success, to reduce this absured sanskritisation, but still, at the present day many words current in literary Bengali mere ideograms. Under such circumostances literary Bengali is divorced from the comprehension of every native to whome it has not been specially taught."


এখানে স্যার জর্জ গ্রীয়ার্সন বলছেন(বোল্ড করা অংশে)-
গদ্যে বইপত্র যা লেখা হতো উনিশ শতকের প্রথমভাগ অবধি, তাতে সংস্কৃত ভাষার শব্দ জোর করে ঢুকানো হয়েছিল। এখানে শতকরা নব্বইটি শব্দ মূল বাঙালা শব্দকে বহিস্কার করে সে সব স্থানে সংস্কৃত শব্দকে ধার করে এনে বসিয়েছেন সংস্কৃতনিষ্ঠ লেখকরা; অথচ এই লেখকরা নিজেরাও তা উচ্চারণ করতে পারতেন না।

তিনি শতকরা নব্বইটি 'প্রকৃত বাঙালা শব্দ' বিষয়টি নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে পাদটিকায় লিখেছেন-
"This estimate is based on actual counting." অর্থাৎ-"এই হিসাব সঠিক গণনার ভিত্তিতে প্রদত্ত।"

উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে দেখা যায়, বাঙালা গদ্যের প্রকৃত ওয়ালেদ বা পিতা ছিলেন মুসলমানরা। তাদের হাতে বাঙলা ভাষার জন্ম এবং তাদেরকেই বাঙালী বলা হত।


সূত্র-
এক. Sir George Griearson. The Indean Empire Cal. 1912 p. 251
দুই. ড. এস. এম. লুৎফর রহমান। মুসলমানরাই বাঙালা ভাষার আদি ওয়ালেদ। সাপ্তাহিক রোববার, ঈদুল আযহা সংখ্যা, ২০০১।
তিন. অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান। বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস। প্রথম খণ্ড। ফেব্রুয়ারী-২০০৪।