শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

কাজল দিঘীর টানে....


গ্রীষ্মের ছুটি।

হাইস্কুল ভবন আর হোস্টেল নিরব নিথর হয়ে গেছে। খেলার মাঠটা যেন আরো বেশি শুন্যতায় ছেয়ে আছে।
বিকেলে মাঠে যাই। উপলক্ষ মাঠের ওপারের একটি জানালা। না, সেখানে কোন সাড়া নেই। মধুমাস উদযাপনে সপরিবার গ্রামে গেছেন স্যারেরা।

আমার তবু ভাল লাগে একা মাঠের পাশে ঘন দুর্বাঘাসের চাদরে শুয়ে বিকেলটা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু কত দিন আর! দু'তিন দিন পার হতেই অধৈর্য হয়ে পড়ি। প্রতিক্ষার ক্ষণ যে কত দুর্বিসহ, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

বাসায় কেন জানি বিষয়টা ফাস হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। একটা গুমট অবস্থা। অবশেষে দূরছাই বলে এক সকালে ক্যানভাসের ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য টুঙ্গিপাড়া পার হয়ে মধুমতির তীরে এক ছায়াঘেরা সবুজে মোড়ানো পাখি ডাকা কাজল দিঘীর গাঁও।



রূপসার ঘোলা জলে সাদা ফেনা ছড়িয়ে ফেরি এগিয়ে চলেছে। রেলিং ধরে দূরে তাকিয়ে আছি। বাতাসে চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। নিমগ্নতায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দূরাগত বাতাস কী যেন কথার আভাষ ফিসফিসিয়ে বলে গেল। আমি কি সেই কথা শুনতে পেলাম। বরিশালের মঠবাড়িয়ার কোন এক তাল-তমালে ঘেরা বাড়ির অন্দরমহলের পুকুরের শান বাধানো ঘাটে বসে আছে এলো চুলের এক কিশোরী। তার হৃদয় জুড়ে ডাহুকের একটানা আকুলি ঝরে পড়ছে। মন তার পড়ে আছে ফেলে আসা যত আবিররাঙা ঘটনায়।

নারকেল তেলের সুবাস এসে চৈতন্যে আঘাত করে। আমি ফিরে তাকাই। পাশে একদল কিশোরী হল্লা করছে। ষাট গম্বুজ আর খাঞ্জেলি দিঘী ওদের গন্তব্য। অভিভাবকেরা তাড়া দিচ্ছেন, ফেরি ঘাটে ভেড়ার সময় আচমকা ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সবাই শক্ত করে রেলিং ধরে যেন দাড়ায়।

এপারে আগে ট্রেন ছিল। ফকিরহাট নেমে মোল্লাহাট হয়ে বহুবার গিয়েছি। এখন ট্রেন নেই। লক্কড় মার্কা বাসে হুড়োধাক্কা খেতে খেতে মোল্লাহাট চলেছি। ফকিরহাটে রাস্তার দুপাশে পানের বরজ। সাপের মত রাস্তা। কোথাও খুব খারাপ অবস্থা। গাড়ি খাবি খেতে খেতে এগিয়ে চলছে হাটার গতিতে। ভেতরে আমরা দলাই-মলাই হচ্ছি। এরমধ্যে দেখি হুটহাট করে শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টার এডভেন্চারে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে গেল। মোল্লাহাট গিয়ে তারপর লঞ্চে টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি ঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে হাটা পথে কাজল দিঘীর গাঁও।

কপাল মন্দ। লঞ্চ ফেল করেছি।

এবার হাটা ছাড়া উপায় নেই। আমরা দল বেধে রওনা দিলাম। পথে অচেনা বাড়িতে বাড়িতে খই-গুড়-পানি খেলাম।
তিন ঘন্টার মত হাটতে হল। অবশেষে মিঠের কুল গাঁওয়ের দেখা মিলল।

বাড়িতে ঢুকতেই মামাত বোনটা দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ল। চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল। ওমা...দাদা এসেছে! কী মজা! কী মজা!

আনন্দের অতিশয্যে সে ভুলে গেছে যে এখন সেও বড় হয়ে গেছে। সেই কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তারপর আমায় আষ্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকা তার লাউলতার মত হাতদুটোর বাধন খুলে পালিয়ে গেল।

আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইলাম।

চলবে-

পর্ব এক
পর্ব দুই
পর্ব তিন
পর্ব চার
পর্ব পাঁচ

ছবি-নেট থেকে

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

হোসেনী দালানে দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি


রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তন ১৬০৮ খৃস্টাব্দে সুবাদার ইসলাম খানের হাতে। এই ঢাকায় দু'বছর সম্রাট জাহাঙ্গীর কাটিয়ে গেছেন। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ঢাকায় থেকে দীর্ঘকাল সুবাদারি করেছেন বাঙলার। ঢাকার ঐতিহ্য পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।

পুরান ঢাকার নিমতলীর পাশে একটি প্রাচীন স্থাপনা হোসেনী দালান (হুসাইনী দালান, ইমামবাড়া)। শাহ সুজার নিজামতের নেওয়াড়ের দারোগা মীর মুরাদ ১০৫২ হিজরি মোতাবেক ১৬৪২ খৃস্টাব্দে এই ইমারতটি নির্মাণ করেন।


প্রসিদ্ধি আছে যে, মীর মুরাদ এক রাতে স্বপ্নে দেখেন হযরত ইমাম হুসাইন রা. একটি ইমামবাড়া(শোকাগার) তৈরি করেছেন এবং তিনি মীর মুরাদকেও নির্দেশ দেন যেন তাঁর স্মৃতিরূপে একটি ইমামবাড়া তৈরি করা হয়। এ স্বপ্ন দেখার পরের দিন মীর মুরাদ এ ইমামবাড়া নির্মাণ শুরু করেন এবং সদিচ্ছা নিয়ে তিনি এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।

এটি একটি অত্যন্ত মনোরম দ্বিতল ভবন। এতে দুটি মিনার, দক্ষিণ দিকে বারান্দার নিচে একটি প্রশস্ত জলাশয়, উত্তর দিকে একটি প্রশস্ত মাঠের পর দেউড়ি(ছাদযুক্ত প্রধান তোরণ) এবং দ্বিতল নহবতখানা, পশ্চিমে তাজিয়া প্রভৃতির ঘর। এর সাথে একটি দ্বিতল আলাদা ঘরে পুলিশের সেকশান। চারদিকে ঘেরার দেয়ালএবং দক্ষিণ দিকেও একটি দেউড়ি।


১৯০৪ সালে হোসেনী দালানের দক্ষিণ ভিউ

মহররম মাসে এসব দেয়ালের তাকের ওপর প্রদীপ দিয়ে আলো জ্বালানো হয় এবং দালানের ওপর মেহরাব ও মিনারের ওপর আয়নার ঢাকনা লাগিয়ে আলো জ্বালানো হয়। এতে দালানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং দেখতেও সুন্দর লাগে। মীর মুরাদের পর ঢাকার নায়েব-ই নাযিমগণ এ ইমামবাড়ার মুতাওয়াল্লী থাকেন। তারা এর ব্যয় বাবদ নিজামত(সরকারি কোষাগার) থেকে বছরে আড়াই হাজার টাকা খরচ বরাদ্দ করেন। যা আজকাল সরকার থেকে পাওয়া যায়। ব্যবস্থাপনার জন্য একজন দারোগা নিযুক্ত থাকেন এবং অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে কাজকর্ম সমাধা হয়।

১৮৯৭ খৃস্টাব্দের ভূমিকম্পে এ বাড়ির অধিকাংশ ভেঙ্গে পড়ে গেলে ঢাকার নওয়াব স্যার আহসান উল্লাহ বাহাদুর আনুমানিক এখলাখ টাকা ব্যয়ে তা নতুনভাবে নির্মাণ ও মেরামত করে দেন।

হুসাইনী দালানের শিলালিপির অবিকল বর্ণনা নিম্নরূপ:
" দর জমানে পাদশাহ ব ওকর----ইন আজিমশ শানে শাহ ন মদার
সাখতে আয়ে ম ছেওয়া সাইয়েদ মুরাদ----দরসনে পানজ অ দর ছার একে হাজার সানাত হিজরি ১০৫২"

ফারসী থেকে অনুবাদ- ওই মর্যাদাবান পরাক্রান্ত ও প্রসিদ্ধ বাদশাহের আমলে সৈয়দ মুরাদ এক হাজার বায়ান্ন সালে এই শোকাগারটি নির্মাণ করেন।১০৫২ হিজরি।


১৯১০ সালে মারা যাবার আগে মুনশী রহমান আলী তায়েশ তার রচিত জীবনের শেষ প্রামান্য গ্রন্থ 'তাওয়ারিখে ঢাকা'য় হোসেনি দালান সম্পর্কে এ বর্ণনা লিখে গেছেন।

এরপর নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে আশির দশকে এর অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে মেয়র হানিফের সময়ে পুকুরসহ এর ব্যাপক সংস্কার হয়। ২০১০ সালে এসে এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ ব্যাপকভাবে করা হয়। হোসেনি দালানে ভেতরের ও বাইরের অঙ্গসজ্জা ও সংস্কারে ফুটে উঠেছে ইরানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাশৈলী রূপ। সৌন্দর্যবর্ধনের এ কাজ করেছে ঢাকার ইরানি দূতাবাস। জানা যায়, ইরান সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় এতে ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা অংশ নেন। সাত মাস ধরে এ কাজ চলে।


দালানের অভ্যন্তরভাগ

সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কারকাজের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশেষকরে আরবি ক্যালিগ্রাফি কুরআনের আয়াত,সুরা, রাসুল, আহলে বায়তের নাম ইরানি সুলুস লিপিতে করা হয়েছে।


ক্যালিগ্রাফি করছেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম

মূল ইমারতের ভেতরে ছাদের চারপাশে কাচের নকশা লাগানো হয়েছিল কিন্তু তা খসে পড়ে। সেখানে সুলুস লিপিতে উৎকীর্ণ সুরা আল রাহমান করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম এ ক্যালিগ্রাফিটি করে দেন। কালো ব্যাক গ্রাউন্ডের ওপর সোনালী রংয়ের লেখা খুবই আকর্ষণীয় এবং মনোহর।

ছবি-নেট থেকে

শনিবার, ২৪ মার্চ, ২০১২

ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বিশ্বখ্যাতি এনেছিল বাঙলার যে লিপিশৈলিটি....!!!!


বাঙলার শিলালিপি নিয়ে তেমন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ হয়নি। যদিও মার্বেল পাথরের ওপর হরফ অঙ্কন এবং তা খোদাইয়ের ব্যাপারে অল্প-বিস্তর আগ্রহ ছিল। কিন্তু প্রাচীন শিলালিপি নিয়ে কখনও আগ্রহটা যে গভীর হবে, সেটা ভাবিনি।

নেট ঘাটতে গিয়ে এ সংক্রান্ত লেখা পড়ে এবং হাজার দুয়েক টাকা অতি কষ্টে কোরবানি দিয়ে শিলালিপির ওপর দাতভাঙা একটি বই কিনে মনে হল, এবিষয়ে দু'চার কথা না লিখলে হয়ত পেটের ভাত হজম হবে না।

জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত যেসব শিলালিপি দেখেছি। তার অধিকাংশ কালোপাথরের। আর এসব পাথরে কিভাবে লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছে, লিপির শৈল্পিক মান, সমসাময়িক লিপিকার, খোদাইকার বিষয়ে কৌতুহল বেড়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে এবিষয়ে খোজখবর নিতে গিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উকি দিয়েছে মনে।

গত নভেম্বরে ঢাকায় প্রাচীন শিলালিপির একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে চুরাশিটি ছবি ছিল। প্রদর্শনীর আয়োজক ঢাকার স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটি প্রায় দুই শতাধিক শিলালিপি খুঁজে পেয়েছেন শুধুমাত্র ঢাকাতে। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য শিলালিপির সন্ধান মিলেছে। এর প্রায় সবগুলোই সুলতানী এবং মোগল আমলের। এত বিপুল সংখ্যক শিলালিপির লিপি হচ্ছে আরবি এবং ফারসি। আর এগুলো সবই ধর্মীয় ইমারত বিশেষ করে মসজিদের ভেতর থেকে পাওয়া গেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, সুলতানি আমলের গুলো আরবিতে এবং মোগল আমলের গুলো ফারসিতে কেন লেখা হয়েছিল? আর এগুলো প্রায় সবই ছিল ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক।

এখন যেমন নামফলক বাঙলা এবং ইংরেজিতে লেখা হয়। মাঝে মধ্যে চীনা-জাপানি ভাষায়ও নামফলক লেখার কথা জানা যায়। এখানে মূল ব্যাপার হচ্ছে যিনি নামফলকটি তৈরি করিয়ে নিচ্ছেন, তার ইচ্ছে অনুযায়ী তা করা হয়। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে। যখন যে নামফলক লাগানো হয়, তা পড়ার লোকজনেরও তখন অভাব ছিল না। সোজা বাঙলায়, নাম ফলকের ওপরে যাই লেখা হোক না কেন, সেটা স্থাপনের সময় পড়ার লোকের অভাব ছিল না।

নামফলক সমসাময়িক পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের জীবনমান ও শিল্পবোধের আয়না স্বরূপ। নামফলকের উপাদান যেমন- পাথর, বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন মানের ও দামের পাথর পাওয়া যায়। সাদা মার্বেল 'কারারা' সাধারণত লেখার কাজে বেশি ব্যবহার হয়। এটা পর্তুগাল ও ইতালি থেকে আসে। আর পাকিস্তান ও ভারত থেকেও মার্বেল আসে, তা নিম্নমানের। কিছুদিন পর সাদা পাথর লালচে রঙ ধারণ করে খোদাই নষ্ট হয়ে যায়। সাদা পাথরে সাধারণত হরফ খোদাই করা হয়। এছাড়া বেলে মার্বেল পাথরেও লেখা হয়। তবে তা কদাচিত।

বর্তমানে কালো পাথর লেখার কাজে ব্যবহার হয় খুবই কম। এটাতে লেখা সবচেয়ে পরিশ্রমসাধ্য এবং খরচ বেশি। এতে হরফ খোদাই না করে জমিন খোদাই করা হয়। এজন্য দক্ষ ও নিপুন হাতের কারিগর ছাড়া তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।




বাবুবাজার জামে মসজিদে সংরক্ষিত শিলালিপি সম্পর্কে লেখা পড়ে এ ব্যাপারে আরো জানার আগ্রহ হল। মসজিদের তৃতীয় তলায় রক্ষিত কালো পাথরটি সরজমিন দেখে মনে হল, পাঠোদ্ধার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি এর লিখন কৌশল, লিপির শৈলিমান এবং ততকালিন এই লিপিশিল্পের দক্ষতা ও নিপুনতা নিয়ে আলোচনাও গুরুত্বের দাবিদার এবং এতে কিছু অজানা বিষয় জানা যেতে পারে।

ক্যালিগ্রাফি বিদ্যায় আরবি লিপিতে তিনটি হরফ যথা-আলিফ, বা, নুন হচ্ছে মূল হরফ। অধিকাংশ হরফ এ তিনটি হরফের সমন্বয়ে গঠিত। এছাড়া জিম হরফের মাথা ও নোকতা বদল করে পাঁচটি হরফ পাওয়া যায়।

আলিফ হরফটি ত্বোয়া, যোয়া, কাফ এবং লাম হরফে আছে। এছাড়া লাম-আলিফ একত্রে লিখতে আলিফকে একটু হেলানো হয়। একে আলিফ মায়েলা বলে।



বাবুবাজার জামে মসজিদের নামফলক


মিলিয়ে দেখার জন্য একটি নমুনা




এই শিলালিপিটির একটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এটি বাঙলার স্বাধীন সুলতান ইলিয়াস শাহী বংশের একটা বিশেষ চিহ্ন বহন করে। আরবি ক্যালিগ্রাফির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লিপি হচ্ছে সুলুস লিপি। একাদশ শতকে এ লিপি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পবিত্র কুরআনসহ সব ধরণের লেখায় অলঙ্করণের কাজে এলিপির ব্যাপক ব্যবহার হতে থাকে।

নামফলকে আগে কুফি লিপির একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু সুলুস এসে তার স্থান দখল করে নেয়। তবে পাথরে খোদাই করতে গিয়ে দেখা যায় সুলুসের পূর্ণ বৈশিষ্ট্য ঠিক থাকছে না। ক্যালিগ্রাফার আর খোদাইকারদের কাছে এসমস্যা বেশিদিন জমে থাকেনি। সুলুস লিপিকে ভেঙে খোদাইকারের ছেনির ঘাত সহায়ক একটি নতুন লিপি উঠে আসে। তার নাম রাইহানী লিপি। তুর্ক-আফগান ক্যালিগ্রাফার রাইহান এ লিপির আবিস্কারক। এটা সরল এবং গোলায়িত রেখার চমৎকার সমন্বিত একটি লিপি।


বেঙ্গল তুগরা


মুদ্রায় বেঙ্গল তুগরা

কিন্তু বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা এ লিপি দিয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন তাদের পাললিক নমনিয়তা আর উল্লম্ব রেখার আশ্চর্য্য সম্মিলন ঘটিয়ে। বিশ্বব্যাপী সেই নতুন লিপির নাম ছড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস শাহী বংশের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলার ক্যালিগ্রাফাররা আবিস্কার করেন "বেঙ্গল তুগরা"।
পানিতে সন্তরণরত হাস, নৌকা, চালাঘর, তীর-ধনুকসহ নানান রকম আর বৈচিত্রে বেঙ্গল তুগরাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। কখনও তা ঘন বন বা বাশঝাড়ের মত করে উৎকীর্ণ করা হত। এই বেঙ্গল তুগরা সুদূর মিসরে সে সময়ের মামলুক সুলতানদেরও হৃদয় হরণ করেছিল। ১৩৬২ খৃস্টাব্দে সুলতান হুসাইন বিন শাবান নিজেই বেঙ্গল তুগরা দিয়ে ক্যালিগ্রাফি করেছেন।


সুলতান হুসাইন বিন শাবান-এর বেঙ্গল তুগরা

বেঙ্গল তুগরার দিন শেষ হয়ে যায় মোগলদের চাপিয়ে দেয়া ফারসি লিপির আগ্রাসনে। শাসক বদল হয়। আরবির বদলে ফারসি রাজদরবার দখল করে। ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাঙলার গৌরব অস্তমিত হয়। কিন্তু সেই বেঙ্গল তুগরা আবার নব রূপে ফিরে আসতে পারে শিল্পী-ক্যালিগ্রাফাররা যদি এতে মনোনিবেশ করেন।


ছবি-নেট থেকে মারিং

পাতলা কাহিনী.......!!!!




বাড়ীতে গিয়েছি অনেকদিন পর। সমবয়সীদের সাথে বিকেলে পুলের ওপর বসে আড্ডা মারছি। নানান বিষয়ে রকমারি প্যাচাল আর চাপাবাজি চলছে।

আমাদের ছিকু ভাই হাফেজ। নাম আসলে অছিকুর রহমান। আমরা ডাকি ছিকু ভাই। তো, ছিকু ভাই খুলনা শহরে থাকে, সপ্তাহন্তে গ্রামে আসে, পুলের ওপর শুক্কুরবার বিকেলে আড্ডা মারতে না পারলে তার নাকি পরবর্তি সপ্তাহ ব্যাপি পেটের মধ্যে বাটবুট করে এবং দাওয়াতের (মরা বাড়ীসহ দোকান ওপেনের মিলাদ পর্যন্ত) খাবার হজম হয়না। তাই কষ্ট করে হলেও সাইকেল দাবড়িয়ে বাপের ভিটেয় আসতে হয়।

আসলে ঘরে একখান নয়া জিনিস আইছে, সেটা অন্যরা জানলেও আমার জানা ছিলনা। তাই তার এই বয়ানে আমার কিঞ্চিৎ সন্দু থাকলেও অন্যরা দেখি দাত ক্যালাইতেছে।

বুঝলাম, ডাইলের অম্বলে দুই একখান নকরোচ লেদি আছে!! তো, ছিকু ভাইয়ের দাওয়াতের হালচাল জিগাইলাম।

পরথমে এড়াইয়া গেল। কিন্তু আমাদের কালা কুদ্দুসের বিষয়টা নজর এড়াল না। সে চাইপা ধরল- আইচ্ছা ছিকু। গত সপ্তায় শুনলাম তোর নাকি হেব্বি ঝোলা নামছিল(লুজ মোশন আর কি)? কাইনি কি? কইয়ালাও। নাকি সুন্দর মেশিনে ডিউটি বেশি পড়ছে? তার কথায় আমরা তখন হা হা প গে।

এইবার বুঝলাম ছিকুর সপ্তাহ মারার কাহিনী। যাইহোক, ছিকু তার পাতলা ঘটনার বয়ান দিল।

ছিকু যে মসজিদের হাফেজি মক্তবে ছেলে-পিলে পড়ায়, সে মহল্লায় একটা কলোনি আছে। কলোনির এক লোক দাওয়াত দিয়ে গেছে, তিন-চারজন তালবিলিম নিয়ে দুপুরে চারট্টা ডাল-ভাত খাবেন। যথা সময়ে ছিকু তার সাগরিদসহ উপস্থিত।

-এটা কি সঞ্জু সাবের বাসা?
-জে, আপনারা কি বাবদে?
-সঞ্জু সাবে আমাদের দুপুরের দাওয়াত করছেন।
-আসেন, বসেন। উনি তো সন্ধ্যায় ফিরবেন বলে ভোরে বাইরে গেছেন। আর আপনাদের কথাও কিছু বলেন নাই!
- ও..তাইলে আমরা আসি।
-না না! আপনারা যাবেন না। উনি বলেন নাই আমাকে, তাতে কি হইছে। আপনারা বসেন। অল্প সময়ের মধ্যে খাবার তৈয়ার হয়ে যাবে। (পর্দার আড়াল থেকে ঘরের মহিলার এমন অনুনয় শুনে ছিকু সাগরেদদের নিয়ে বসে পড়ে এবং কুরান পড়া শুরু করে।)

কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার এসে পড়ে। ছিকু মুনাজাত শেষ করে সাগরেদদের নিয়ে খেতে বসে।

ভাজি-চচ্চড়ি, মুরগি, পাঁচ ফোড়ন দেয়া ডাল, লুচি আর লাল চালের চিকন ভাত বেশ উপাদেয় লাগে। ঘরে সাত-আট বছরের এক ছেলে খাবার আনছে ভেতর থেকে। এর মধ্যে ছোট্ট পেতলের একটা বাটিতে ভুনা মাংস আনা হলো। ছিকু ভাবল, এটা তার জন্য স্পেশাল। খেতে বেশ মজা, তবে একটু পোড়াভাব আর টকটক গন্ধ। যাইহোক, খাবার শেষে বিদায়ের পালা। পাত্রগুলো ভেতরে নেয়া হচ্ছে।

হঠাত মহিলা তার বাচ্চাকে নিচু স্বরে বলছে, বাবু! এই বাটির মাংস ত তোমাকে নিতে কই নাই!
-ক্যান মা? তারা কি এ মাংস খান না!
-না অনারা!.. আচ্ছা বাবা চুপ করো কিছু কইও না। আমারই ভুল হইছে।

ছিকু আর তার ছাত্ররা মক্তবে এসে দেখে সেই লোক বসে আছে। তাকে দেখে সে ক্ষুব্ধ কন্ঠে কইল।
-কখন থেকে আপনার জন্য বসে আছি।
-আমরা তো আপনার বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আপনার ছেলে পলু আমাদের খাবার এনে খাওয়াল আর আপনি নাকি বিকেলের আগে বাসায় ফিরবেন না!
-কি সব বলছেন? আমার ত কোন ছেলেই নেই! আচ্ছা, আপনারা কি হলুদ বিল্ডিংয়ের নিচতলার বাসায় গেছিলেন?
-হ্যা, কেন ওটা আপনার বাসা না?
-না না! ওটা তো সঞ্জু বাবুর বাসা। কেন বউদি আপনাদের বলেনি!
-ওহো! ভুল বাসায় দাওয়াত!

-যাকগে এসব। চলেন, দেরি হয়ে গেল।
-না মানে! আমার ছাত্রদের নিয়ে যান।

কয়েকজন ছাত্র নিয়ে সঞ্জু মিয়া চলে যায়। আর এদিকে ছিকুর কেবলই মনে হতে থাকে, পেতলের বাটিতে কিসের মাংস ছিল!!!

এরপরই অনিবার্য ফলাফল...পাতলা কাহিনী।

ছবি-নেট থেকে মারিং

শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১২

মোল্লাদেশের ক্যারিকেচার আর্ট...!!!




আমাদের কয়েকজন কার্টুন শিল্পী কয়েক বছর আগে বিদেশের এক কার্টুন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্বভাবতই আকাআকিতে ভাল। এবং সেখানে তারা পুরস্কারও অর্জন করে। সেটা ছিল অনুর্ধ ২৫ বছর বয়সীদের প্রতিযোগিতা।



কিন্তু সেখানে গিয়ে আমাদের ছেলেরা বিস্ময়াভূত হয়েছিল। কারণ তাদের ধারণা ছিল না যে, মোল্লাদেশের পোলাপাইন এত দক্ষ আর ভালো মানের কার্টুন আকতে পারে।



দেশটি হচ্ছে ইরান। সেদেশের একজন টিনেজ কার্টুনিস্ট হচ্ছে আলি রেজা বাঘেরি। প্রতিযোগিতায় সে প্রথম স্থান অর্জন করে।











এগুলো আলি রেজার ক্যারিকেচার।

অসাধারণ এই কার্টুনিস্ট তার পরিবারের আট সদস্যের মধ্যে সর্ব কণিষ্ঠ এবং বোবা।

________________________________________________________________________‍‍






বাংলাদেশের কার্টুনিস্ট মেহেদির ক্যারিকেচার

ছবি- নেট থেকে

শুক্রবার, ৯ মার্চ, ২০১২

বাঙলা ক্যালিগ্রাফি : ভিন্ন এক শিল্প আলেখ্য




বাঙলা অক্ষর নিয়ে বাঙালদের ঐতিহ্যচিন্তা এ ভাষার প্রথম পথচলা থেকে শুরু হয়েছে। শুধু প্রয়োজন বলে কথা নয় হৃদয়ের আকুতি এর সাথে মিশে আছে। প্রাচীন পুথিপত্রে লেখাকে সুন্দর আর অলঙ্কার মণ্ডিত করার প্রয়াস বাঙাল ভূখণ্ডে প্রবলভাবে ফুটে ওঠে মধ্যযুগে।



ছাপার হরফে বই আসার পরেও প্রচ্ছদ আর ভেতরের ইলাস্ট্রেশনে বাংলা হরফের শিল্পিত ব্যবহার চালু রয়েছে। কিন্তু হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার আবেগ আর স্পৃহা একেবারে হাল আমলের। আমাদের চারুকলায় বাঙলা হরফ দিয়ে লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি করার কোন ট্রেডিশন দেখা যায় না। বিচ্ছিন্ন দু'একটা কাজ যা আছে তাতে এর প্রতি গভীর অভিনিবেশ প্রায় শুণ্যের কোঠায়।



বাঙলা ক্যালিগ্রাফির বর্তমান যে চিত্র পাওয়া যায় তাতে দুটো প্রধান চরিত্র রয়েছে। এক. বইপত্রে প্রচ্ছদ এবং ইলাস্ট্রেশন দুই. লিপিকলা।



বইয়ের প্রচ্ছদে শিরোনাম ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখার ক্ষেত্রে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী হচ্ছেন অগ্রনায়ক। তার তুলির টানে হরফের শিল্পিত অবয়ব একটি ধারার সৃষ্টি করেছে। এ ধারায় যারা কাজ করেছেন তারা প্রায় সবাই চারুকলার।



প্রায় একই রকম হরফের বলিষ্ঠভাব নিয়ে শিল্পী হাশেম খানের তুলির টানে অন্য একটি ধারা দেখা যায়। তবে হাশেম খানের হরফে একটা গ্রামীণ সরল ভাবের সাথে শিশুর সরলতার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্যদের মাঝে দেখা যায় না।



আর বাঙলাবাজারে ধর্মীয় বইপত্র এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখা বইয়ে আরবি হরফের আদলে বাঙলাহরফে ক্যালিগ্রাফিরও দেখা মেলে।



হাতে লেখা সাইনবোর্ড ও দেয়াল লিখন :

এখন আর হাতে লেখা সাইনবোর্ড প্রায় দেখা যায় না। দুই দশক আগেও চমৎকার আর্টিস্টিক বাঙলা হরফে সাইনবোর্ড লেখা হত। হরফে আলোছায়া আর উচুনিচু ভাবের সাথে শিল্পিত ছোয়া ছিল অসাধারণ। তেমনিভাবে দেয়াল লিখন আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বামপন্থীদের দেয়াল লিখনে যে শিল্পিত রূপ ছিল তা অন্যদের বিমোহিত করত।



একুশে উদযাপন উপলক্ষে শহীদ মিনারের আশেপাশের দেয়াল লিখন এক সময় এত বিচিত্র আর মান সম্পন্ন ছিল যে সৌন্দর্যপিপাসুরা দাড়িয়ে দাড়িয়ে তা নয়ন ভরে দেখত। চারুকলার ছাত্ররা বরারবর এই লেখাকে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করত। এখন আর সেই মান নেই।



এক সময় দেয়াল পত্রিকা পাড়া মহল্লায়ও বের করা হত। এখন শিক্ষাঙ্গন থেকেও তা প্রায় হারিয়ে গেছে। এসব লেখালেখিতে হরফকে সুন্দর করার যে প্রয়াস ছিল তাতে শিক্ষিত মাত্রই সুন্দর হাতের লেখার একটা গুরুত্ব ছিল। আর এখন অধিকাংশ ছাত্রের হাতের লেখা দেখলে বাংলা হরফের প্রতি ভালবাসা দূরে থাক যেন হরফকেই তারা ভুলতে বসেছে।



এই চিত্রের উল্টোদিকও আছে। বাঙলা হরফে ক্যালিগ্রাফি করার একটা প্রয়াস ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। পেইন্টিংয়ে হাশেমখান, কাইয়ুম চৌধুরী আর আবদুস সাত্তার বাঙলা হরফকে অনুসঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করছেন। চারুকলার সাম্প্রতিক কাজেও তা প্রভাব ফেলেছে।





অন্যদিকে বলা যায় একাডেমিক শিল্পচর্চার বাইরে কিছু শিল্পী তাদের শিল্পকর্মকে বাংলা ক্যালিগ্রাফি হিসেবে তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের কাজে অভিনিবেশ আর কঠোর সাধনা লক্ষ্য করা যায়।









এসব বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে ধর্মীয় ভাব প্রাধান্য পেয়েছে টেক্সট ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তাছাড়া দেশ মাতৃকা ভাষার প্রতি কমিটমেন্টও এসব কাজে দেখা যায়। তবে ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পমানে কোন ছাড় দিতে রাজি নয় এসব শিল্পী। সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, আবদুর রহীমসহ প্রায় শতখানেক শিল্পী বাঙলা ক্যালিগ্রাফির একটি নতুন ধারা দাড় করিয়ে ফেলেছেন।

আরহামের পিকটোগ্রাফি:



আরহামুল হক চৌধুরী বাঙলা হরফকে নানান রকম পেচিয়ে বাকিয়ে যেকোন বস্তু বা প্রাণীর চিত্র একেছেন। তার কাজে প্রবাদ প্রবচন এসেছে চিত্রের অবয়ব তৈরিতে সাচ্ছন্দ্যরূপে। ছবির আবেদনের সাথে অবয়ব এবং টেক্সট মিলে একাকার হয়ে গেছে। এধরণের নিরীক্ষাধর্মী কাজে ঐতিহ্যকে ভিন্নভাবে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যা কিছুটা নগর জীবনের বিলাসের ভেতর লোকশিল্প ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা।

এই হচ্ছে চলমান বাঙলা ক্যালিগ্রাফির চিত্রালেখ্য।


ছবি- নেট ও আমার সংগ্রহশালা থেকে।

মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১২

ক্যালিগ্রাফির প্রেমে এলিনূর হল্যান্ড..



যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি নিরিবিলি শহরতলি। সেখানে মেয়েটির শৈশব কাটে এক রকম বৈচিত্রহীন পরিবেশে। টিনেজ বয়সটা রঙ আর স্বপ্নে বিভোর। পড়াশুনা করতে করতে তার শুধু মনে হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে।

এক সামারে তার সেই সুযোগ মিলে যায়।

এক তুর্কি পরিবারের আমন্ত্রণে সে ইস্তাম্বুল আসে। এখানে নতুন পরিবেশ, সংস্কৃতি আর একটি বিশেষ ধরণের আর্ট তাকে বিহ্বল করে তোলে। কিশোরী মনে তার দূরের স্বপ্ন জাগে। সে একজন ক্যালিগ্রাফার হবে। আরবি হরফের এই আর্টের প্রেমে সে দিওয়ানা হয়ে যায়। কিশোরীর প্রথম প্রেম বলে কথা!

ঘরে ফিরে কিছুই ভাল লাগে না। সারাদিন সে কালি আর খাগের কলম দিয়ে কাগজে হরফ একে চলে। তুরস্কে ক্ষণকাল আবাসে সে হরফগুলো আঁকা শিখেছিল। এরপর ক্যালিগ্রাফির টানে বহুবার তুরস্কে যেতে হয়েছে তাকে। সেই টিনেজ বয়সেই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় সে।

ইসলাম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন এলিনূর আয়েশা হল্যান্ড।



ক্যালিগ্রাফির পাশাপাশি তিনি টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিলিজিয়াস স্টাডিজে বিএ এবং পেনসিলভানিয়া ইউনিতে আরবিতে পড়াশুনা করেন। এছাড়া কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেন্টার ফর এরাবিক স্টাডিজে সামার প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন।



একটানা কুড়ি বছর ধরে বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে ক্যালিগ্রাফির দীক্ষা নেন। মোহাম্মদ জাকারিয়া আর বাগদাদের উইস্সাম শাওকাত তার ওস্তাদদের অন্যতম।



এলিনূর প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী আরবি ক্যালিগ্রাফির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বিভিন্ন মিউজিয়ামে রক্ষিত আরবি ক্যালিগ্রাফির শিল্পকর্ম তিনি চর্চা ও প্রতিলিপি করা শুরু করেন। লাতিন হরফের ক্যালিগ্রাফিও এর সাথে আয়ত্ব করেন। বিশেষ করে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইতিহাস, উন্নয়ন, ক্রমধারা, প্রয়োগ এবং এর নিগুঢ় কলাকৌশল সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।



১৯৯৪ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন জাদুঘরে, প্রতিষ্ঠানে ক্যালিগ্রাফির ক্লাস নেয়া শুরু করেন। খুব দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক-বাণিজ্যিক পর্যায়ে তার ক্যালিগ্রাফির সংগ্রহ বেড়ে যায়।



স্মিতোনিয়ান ইনস্টিটিউট, নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরি, ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ, নিউইয়র্ক সোসাইটি অব স্ক্রাইব ও লং আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় তিনি ক্যালিগ্রাফি প্রেজেন্টেশন এবং প্রদর্শনি করেছেন।

এছাড়া বৃটিশ মিউজিয়ামে তার ক্যালিগ্রাফি ওয়ার্কশপ শিল্পাঙ্গনে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির উপকন্ঠে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।



ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে তিনি বলেন, "এমন একটি চমৎকার নান্দনিক শিল্পকলা যে পৃথিবীতে রয়েছে, তা অনেকেই জানেন না। এমনকি এই ইসলামিক ক্যালিগ্রাফিই তাকে দূত হিসেবে অন্যান্য শিল্পকলার কাছে তুলে ধরেছে।"



সাধনা, অধ্যাবসায়, আর প্রগাঢ় শিল্পপ্রেমের এক জীবন্ত উদাহরণ হিসেবে আমরা এলিনূর আয়েশা হল্যান্ডকে দেখতে পাই। শিল্পাঙ্গনে তিনি উত্তর প্রজন্মের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

ছবি-নেট থেকে মারিং

রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

জাপানের ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি...





১৯৬৯ সালের ঘটনা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজের ছাত্র ছিলেন হোণ্ডা। তখন তার মনে হয়েছিল- "আমি কখনও আর একটি আরবি বই খুলব না। আরবি ভাষাকে আমি ঘৃনা করি। ঐ ভাষার অধ্যাপকদের দুই চোখে দেখতে পারি না। কারণ তারা শুধু আরবি ব্যাকরণ পড়ান আর আরবি উপন্যাস, যা পড়াটা ছিল এক প্রকার অসম্ভব কাজ।"

কিন্তু সৌদি আরবে তার প্রথম পাঁচ বছরের কর্ম জীবনে আরবি ভাষার চলিত এবং ঐতিহ্যিক ধরণ আর আরবি হরফের লাবণ্যময় প্রয়োগ দেখে তার শিক্ষাজীবনের পড়াশুনা তাকে আহত করে। হোণ্ডার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে থাকেন।

"প্রতিদিন আমি সুকে (বাজার) যেতাম আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম, দয়া করে একটু বলেন- এই জিনিসটার নাম কি? এভাবে জিজ্ঞাসা করতাম আর নামগুলো কাতাকানায় (জাপানি হরফ) লিখে ফেলতাম। আমার ধারণা, আমার শিক্ষকরা ছিলেন বোধশক্তির দিক দিয়ে সত্যিকারভাবে সাধারণমানের নাগরিকদের মত, যেমন- ড্রাইভার, কেরানি। তবু তারা ছিলেন টোকিও বিশ্বিবদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।"


হোণ্ডা খুব দ্রুত পেশায় উন্নতি করেন এবং সৌদি তেল মন্ত্রণালয়ের খনিজ-উৎস অনুসন্ধান দলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী তিন বছরের সিংহভাগ সময় তিনি মরুভূমিতে কাটান, যেখানে তিনি বেদুইনদের সাথে ঘনিষ্ট সময় অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেন।
" আমি প্রকৃতির পালাবদলের প্রতি খুব শ্পর্শকাতর হয়ে পড়ি।"



"যখন আমি দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের রুব আল খালি(শূন্য চতুর্থাংশ) এলাকা দেখলাম। মরুর চলমানতার সৌন্দর্য্য আমাকে অভিভূত করে তুলল। জীবন্ত কিছুর মত বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক প্রবাহ ছিল সেটা। আমার পদচিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মরুর দুরন্ত বাতাস সেখানে শিল্প ফুটিয়ে তুলেছে।"

"আমি মনে করি, আরবি ক্যালিগ্রাফির সাথে মরুর বালিয়াড়ির এই চলমান সৌন্দর্য্যের চমৎকার মিল রয়েছে। আরবি হরফের বৈশিষ্ট্যে শৈল্পিক চলমানতার বিষয়টি আমাকে এতটাই বিদ্ধ করেছিল যে, আমি যখন ফিরে আসি, আমার ভেতরে শুধু দুটো জিনিস আলোড়ন তুলছিল। এক. মরুর বালিয়াড়ির সৌন্দর্য্য আর দুই. আরবি ক্যালিগ্রাফি।


হোণ্ডা তার হৃদয়কে অস্বীকার করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে আবার তিনি আরব সংস্কৃতিতে ফিরে আসেন। ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একটি মুসলিম নাম ফুয়াদ(হৃদয়) রাখেন। আরবি ভাষা শিখেন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি শেখায় আত্ননিয়োগ করেন। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফির দৃশ্যপটে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হন।



জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে বেজির পশমের তুলি ফুদে(fude) ব্যবহার হয়। হোণ্ডা সেখানে বাশের কঞ্চির কলম (বুসে) ব্যবহার করে জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তার উদ্ভাবিত ধারার নাম- সোডো আরাবি।
shodo ‘arabi—“the way of Arabic writing.”



আরবি ক্যালিগ্রাফিতে "আল খত আল আরাবি" কয়েকটি বিশিষ্ট লিপিশৈলিকে বলা হয়। তেমনি জাপানি সোডো কথাটার অর্থ হচ্ছে- কানা(জাপানি হরফ) অথবা কানজি(চিনা হরফ) লিপিতে আঁকা বিশেষ ধরণের চিত্রলিপি।

বর্তমানে জাপানের সোডো মাস্টাররা(জাপানের ক্যালিগ্রাফির স্বীকৃত উস্তাদ) ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডাকে সোডো আরাবির জনক হিসেবে অবিহিত করেছেন।



১৯৯৯ সালে তিনি তুরস্কের উস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাচান চালাবির কাছ থেকে জালি দিওয়ানি(বলিষ্ঠ গোলায়িত আরবি লিপি) শৈলিতে ইযাযা(ডিপ্লোমা) অর্জন করেন। এবিষয়ে তিনি বলেন," আমরা প্রচলিত নীতিমালাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি না, যতক্ষণ না ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যিক রূপমাধুর্য্যকে আমরা উতরে যেতে পারছি।"



ইউকারি তাকাহাসি, ক্যালিগ্রাফির একজন ছাত্রী, ইয়ামাওকা(সাদা মার্বেল কাগজে কালো কালিদিয়ে লেখা) ও সোডো আরাবি শিখছেন

আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যাপারে জাপানীদের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কি? এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এবং ছাত্রদের কথা ছিল- সৌন্দর্য্য। এর পেছনে একটাই কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য্য। আমরা সৌন্দর্য্যে আপ্লুত হই।




টোকিওর আরাবিক ইসলামিক ইনস্টিটিউট

জাপানে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইনস্টিটিউট গড়া, সোডো আরাবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করা, জাপানি ক্যালিগ্রাফারদের মাঝে আলোড়ন তোলা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ অঙ্গনে জাপানি ছাত্রদের পুরস্কার অর্জনে যার অবদান একান্ত অনস্বীকার্য। তিনি ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডা। তার কীর্তি আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিতে অমর হয়ে থাকবে।

ছবি - নেট থেকে মারিং