রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১২

জাপানের ক্যালিগ্রাফির জীবন্ত কিংবদন্তি...





১৯৬৯ সালের ঘটনা। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজের ছাত্র ছিলেন হোণ্ডা। তখন তার মনে হয়েছিল- "আমি কখনও আর একটি আরবি বই খুলব না। আরবি ভাষাকে আমি ঘৃনা করি। ঐ ভাষার অধ্যাপকদের দুই চোখে দেখতে পারি না। কারণ তারা শুধু আরবি ব্যাকরণ পড়ান আর আরবি উপন্যাস, যা পড়াটা ছিল এক প্রকার অসম্ভব কাজ।"

কিন্তু সৌদি আরবে তার প্রথম পাঁচ বছরের কর্ম জীবনে আরবি ভাষার চলিত এবং ঐতিহ্যিক ধরণ আর আরবি হরফের লাবণ্যময় প্রয়োগ দেখে তার শিক্ষাজীবনের পড়াশুনা তাকে আহত করে। হোণ্ডার আগ্রহ বাড়তে থাকে এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে থাকেন।

"প্রতিদিন আমি সুকে (বাজার) যেতাম আর স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে জিজ্ঞাসা করতাম, দয়া করে একটু বলেন- এই জিনিসটার নাম কি? এভাবে জিজ্ঞাসা করতাম আর নামগুলো কাতাকানায় (জাপানি হরফ) লিখে ফেলতাম। আমার ধারণা, আমার শিক্ষকরা ছিলেন বোধশক্তির দিক দিয়ে সত্যিকারভাবে সাধারণমানের নাগরিকদের মত, যেমন- ড্রাইভার, কেরানি। তবু তারা ছিলেন টোকিও বিশ্বিবদ্যালয়ের ফরেন স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক।"


হোণ্ডা খুব দ্রুত পেশায় উন্নতি করেন এবং সৌদি তেল মন্ত্রণালয়ের খনিজ-উৎস অনুসন্ধান দলের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী তিন বছরের সিংহভাগ সময় তিনি মরুভূমিতে কাটান, যেখানে তিনি বেদুইনদের সাথে ঘনিষ্ট সময় অতিবাহিত করেছেন। তিনি প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেন।
" আমি প্রকৃতির পালাবদলের প্রতি খুব শ্পর্শকাতর হয়ে পড়ি।"



"যখন আমি দক্ষিণ আরব উপদ্বীপের রুব আল খালি(শূন্য চতুর্থাংশ) এলাকা দেখলাম। মরুর চলমানতার সৌন্দর্য্য আমাকে অভিভূত করে তুলল। জীবন্ত কিছুর মত বালিয়াড়ির প্রাকৃতিক প্রবাহ ছিল সেটা। আমার পদচিহ্নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মরুর দুরন্ত বাতাস সেখানে শিল্প ফুটিয়ে তুলেছে।"

"আমি মনে করি, আরবি ক্যালিগ্রাফির সাথে মরুর বালিয়াড়ির এই চলমান সৌন্দর্য্যের চমৎকার মিল রয়েছে। আরবি হরফের বৈশিষ্ট্যে শৈল্পিক চলমানতার বিষয়টি আমাকে এতটাই বিদ্ধ করেছিল যে, আমি যখন ফিরে আসি, আমার ভেতরে শুধু দুটো জিনিস আলোড়ন তুলছিল। এক. মরুর বালিয়াড়ির সৌন্দর্য্য আর দুই. আরবি ক্যালিগ্রাফি।


হোণ্ডা তার হৃদয়কে অস্বীকার করতে পারেননি। ১৯৭৯ সালে আবার তিনি আরব সংস্কৃতিতে ফিরে আসেন। ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একটি মুসলিম নাম ফুয়াদ(হৃদয়) রাখেন। আরবি ভাষা শিখেন এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি শেখায় আত্ননিয়োগ করেন। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে এবং ১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফির দৃশ্যপটে নিজেকে তুলে ধরতে সমর্থ হন।



জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে বেজির পশমের তুলি ফুদে(fude) ব্যবহার হয়। হোণ্ডা সেখানে বাশের কঞ্চির কলম (বুসে) ব্যবহার করে জাপানি ক্যালিগ্রাফিতে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন। তার উদ্ভাবিত ধারার নাম- সোডো আরাবি।
shodo ‘arabi—“the way of Arabic writing.”



আরবি ক্যালিগ্রাফিতে "আল খত আল আরাবি" কয়েকটি বিশিষ্ট লিপিশৈলিকে বলা হয়। তেমনি জাপানি সোডো কথাটার অর্থ হচ্ছে- কানা(জাপানি হরফ) অথবা কানজি(চিনা হরফ) লিপিতে আঁকা বিশেষ ধরণের চিত্রলিপি।

বর্তমানে জাপানের সোডো মাস্টাররা(জাপানের ক্যালিগ্রাফির স্বীকৃত উস্তাদ) ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডাকে সোডো আরাবির জনক হিসেবে অবিহিত করেছেন।



১৯৯৯ সালে তিনি তুরস্কের উস্তাদ ক্যালিগ্রাফার হাচান চালাবির কাছ থেকে জালি দিওয়ানি(বলিষ্ঠ গোলায়িত আরবি লিপি) শৈলিতে ইযাযা(ডিপ্লোমা) অর্জন করেন। এবিষয়ে তিনি বলেন," আমরা প্রচলিত নীতিমালাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি না, যতক্ষণ না ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্যিক রূপমাধুর্য্যকে আমরা উতরে যেতে পারছি।"



ইউকারি তাকাহাসি, ক্যালিগ্রাফির একজন ছাত্রী, ইয়ামাওকা(সাদা মার্বেল কাগজে কালো কালিদিয়ে লেখা) ও সোডো আরাবি শিখছেন

আরবি ক্যালিগ্রাফির ব্যাপারে জাপানীদের আগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ কি? এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক এবং ছাত্রদের কথা ছিল- সৌন্দর্য্য। এর পেছনে একটাই কারণ হচ্ছে সৌন্দর্য্য। আমরা সৌন্দর্য্যে আপ্লুত হই।




টোকিওর আরাবিক ইসলামিক ইনস্টিটিউট

জাপানে আরবি ক্যালিগ্রাফির ইনস্টিটিউট গড়া, সোডো আরাবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পাঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করা, জাপানি ক্যালিগ্রাফারদের মাঝে আলোড়ন তোলা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির সর্বোচ্চ অঙ্গনে জাপানি ছাত্রদের পুরস্কার অর্জনে যার অবদান একান্ত অনস্বীকার্য। তিনি ফুয়াদ কৌচি হোণ্ডা। তার কীর্তি আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফিতে অমর হয়ে থাকবে।

ছবি - নেট থেকে মারিং

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন