সোমবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অচেনা আকাশ...!!!




এই ছিল তোর মনে!
কতটা বিকেল কেটে গেছে
সুখাগ্ন আলাপে

বিষন্ন দুপুর ছিলনা কখনও
আমাদের আকাশে

দিন শেষে সন্ধ্যার তারারা
সলজ্জ্ব হত আমাদের
খুনসুটি দেখে

কি আবেশ ছিল
পরতে পরতে
হৃদয়ের ভাজ খোলা খামে

আজ একি হলো তোর
কলুষিত বিশ্বাসের ভোর
বিক্রি হয়ে গেলি রংচটা দামে


ছবি-নেট থেকে মারিং

সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১২

প্রাচীন কুফি লিপি নিয়ে কথা...




লৌহজং এলাকায় এক মসজিদে স্থানীয় মাদ্রাসার বড় হুজুর এসেছেন। তিনি মেহরাবের উপরের লেখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। ইমাম সাহেব বললেন, কুফি লিপিতে কালিমা তৈয়্যবা।

হুজুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এটা আবার কি জিনিস, এরকম লিপি ত কোন দিন দেখিনি। এটা ত পড়া যায় না, এমন জিনিস এখানে না দিয়ে বর্তমানের আরবি হরফে দিলে ঠিক হত।

ইমাম সাহেব আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এ বিষয়ে ইনি ভাল বলতে পারবেন।

হুজুর আমাকে দেখে আরো বিস্মিত। অবশেষে বলেই ফেললেন, এই প্যান্ট-সার্ট পরা ভদ্রলোক এসবের কি জানবে!

আমি বললাম, আসলে বিষয়টা আমারও এক সময় জানা ছিল না। ইসলামের প্রথমদিকে প্রায় সাড়ে তিনশত বছর কুরআন এই কুফি লিপিতে লেখা হত, সেটাও আমাদের অনেকের অজানা।

হুজুর এবার সন্দেহের চোখে তাকালেন, কিন্তু মুখে বললেন, আপনার কাছে কি দলীল আছে এ বিষয়ে।

আমার ব্যাগে মুসেআহ আল খত আল আরাবি(আরবি ক্যালিগ্রাফির বিশ্বকোষ) বইয়ের কুফি লিপির একটা কপি ছিল। সেটা তার হাতে দিলাম।



উনি বইটি উল্টে পাল্টে দেখলেন। ভেতরের এক জায়গায় আমাকে পড়তে বললেন। পড়ে শোনানোর পর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আবেগের সাথে বললেন, দীর্ঘ তিন যুগ আমি বুখারির দরস দেই এবং আমার ধারণা ছিল, ইসলাম ও তারিখ(ইসলামের ইতিহাস) সম্পর্কে আমি ভালই জানি। এখন মনে হচ্ছে, আসলে আমি কিছুই জানি না।

নেট ঘেটে কুফি লিপি নিয়ে অনেক কিছুই পাওয়া যায়।



৭ম শতকের কুফি লিপিতে লেখা কুরআনের একটি পাতা।

প্রতি দুবছর পরপর ইস্তাম্বুলে ওআইসির কালচারাল বিভাগ আইআরসিআইসিএ আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশ থেকেও এ প্রতিযোগিতায় অনেকে অংশ গ্রহণ করেন। এ প্রতিযোগিতায় কুফি লিপি এবং মুসহাফ কুফি(কুরআনের কুফি) নামে বিভাগ আছে।



কুফি লিপি আরবি লিপির সবচেয়ে প্রাচীনতম লিপির অন্যতম। সুতরাং এর উন্নয়ন এবং বিচিত্র শাখার উদ্ভব বেশি হয়েছে। এখন এটা ইমারত বা স্থাপত্য লিপি হিসেবে বেশি ব্যবহার হয়।





মধ্যএশিয়ায় স্থাপত্যে বলা যায় মনোপলি ব্যবহার হয়েছে এলিপির।



কুফি লিপিতে কালিমা



কুফি লিপিতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম




১৪ শতকে ইলখানিদ শাসনামলে রুপার মুদ্রায় কুফি লিপিতে কালিমা।


আমাদের দেশেও বিশেষ করে মসজিদে এলিপির ব্যবহার বেড়েছে।



ঢাকার উত্তরার একটি মসজিদের মেহরাবের উপরে কুফি লিপিতে লেখা কালিমা।



কুফিলিপির হাতে-কলমে বইয়ের একটি পাতা। এখানে জিম হরফের নানান বিষয় দেখানো হয়েছে।



কুফি লিপির আরেকটি প্রাকটিক্যাল বইয়ের পাতা। এখানে ক্যালিগ্রাফি ও ইন্ডিভিজ্যুয়াল হরফ দেখা যাচ্ছে।

ছবি-নেট থেকে

শনিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১২

মধুমতি, তোর টানে...


সরষের তেলে চিংড়ি বড়ার স্বাদ
কখনো বাতাসে ভাসে পাটের সোঁদা গন্ধ
মধুমতি, তোর টানে এসেছিরে ফিরে
দুহাত ভরা দেখ, কত আনন্দ

দূরে হাওয়ায় কাঁপে ঘুঘু ক্রন্দন
সাথী আয় ফিরে আয়
আমি যাই, উড়ে যায়
মন যায় তারও আগে
পরি যে আমার ভরা নিশি জাগে

বেলা পার হয় ছায়াবিথিতে ধীরে
অলস সন্ধ্যা নামে
আমায় দেখে সে হঠাৎ দরোজায়
দুচোখে বর্ষা নামে

শুক্রবার, ২৪ আগস্ট, ২০১২

চিকু আলির বাগানবিলাস..




তাকে আমরা কখনও ডাকি ফারমার, আবার কখনও ডাকি টাকাটাকি ইঞ্জিমেকার নামে। তার বন্ধুরা তাকে চিকু আলি ওরফে মিচকা হাসি নামে ডাকতে পছন্দ করে। আর সে নিজকে পরিচয় দেয় শেখ চিকন আলি শেখু। শেখু তার দাদার দেয়া উপাধী।

সারাদিন নানান রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজকে ব্যস্ত রাখে চিকু শেখ। স্কুলের পড়ার বাইরে মাছ-মুরগি চাষ, বাগান করা,
'এসো নিজে করি' নামের ছোটদের বিজ্ঞান সিরিজের বইগুলোর প্রতি তার আগ্রহ বেশি। গ্রাম থেকে দাদা-নানা আসলে চাষবাস নিয়ে রীতিমত পেশাদারি আলাপ চালায় সে। আমরা তাতে বেশ মজা পাই।

বাসায় কোন খেলনা আস্ত নেই। সব তার মহান গবেষণায় প্রাণ বিসর্জন দিছে। এমনকি পুরান মোবাইল, টুইনওয়ানও তার সার্জারির হাত থেকে রেহাই পায় নাই। তবে কম্পু-লেপটপের ওপর উল্টাপাল্টা হাত বুলানোর জন্য হালকা পিঠপালিশও তার ভাগ্যে জুটেছে।



আমার পড়ার ঘরে স্টিলের আলমিরার ওপর সে গবেষণাগার বানাইছে। বারান্দায় বসে ঠুকঠাক করে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে। ওটা হল তার ফিল্ডওয়ার্কের জায়গা। নিজের বানানো ফ্লাশ লাইটের আলো বাড়ানো-কমানো, ব্যাটারি চালিত হাতপাখা, পোকা-মাকড় বড় করে দেখার জন্য বাল্বের ভেতর পানি ভরে তা দিয়ে অনুবিক্ষণ যন্ত্র বানানোসহ হরেক পদের গবেষণা করে সে।

একবার সে স্কুল থেকে ফেরার পথে ইমারত তৈরির মসল্লা মিকচার যন্ত্র দেখে এসে খাতায় সেটা নিজের মত করে আঁকলো। এরপর ছবিতে বিভিন্ন অংশের বর্ণনাও লিখে দিল। মিকচারটা ছয়তলার ছাদে কিভাবে যাবে সেটার একটা ডায়াগ্রাম একে ফেলল। পরে এ মহান গবেষণাকর্ম তার মা পুরোন কাগজপত্রের সাথে ফেরিওয়ালাকে দিয়ে দেয়ায় প্রতিবাদ স্বরূপ এক সপ্তাহ ডাল খাওয়া বন্ধ রাখে সে। কারণ ডাল হচ্ছে তার প্রিয় মেনুর একটা। এবং সেটা অবশ্যই পাতলা হতে হবে। আমাদের খাবার টেবিলে ডাল-স্যুপ-পায়েশ কম্পোলচারি আইটেম।

চিকু শেখের আরেকটা বাতিক হলো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ছবি আঁকা। সেটা সে নিজস্ব স্টাইলে করে থাকে। গরু-বাঘ-মুরগী লাখ বছর আগে কেমন ছিল সেটা আঁকা আর কি। তার মা এসব জন্তুর ছবি আঁকার ঘোর বিরোধী, তাই লুকিয়ে এগুলো সে মাঝে মধ্যে আঁকে এবং আমাকে দেখায়। আমি সমালোচনা করে যখন বলি বাঘের চাইতে দাঁতটা বেশি বড় হইছে। তখন বিজ্ঞের মত করে বলে, এই জন্য ত বর্তমানের বাঘের দাঁত এত ছোট হইছে।

ছোটবেলায় একবার নানাবাড়ীর গরু তাকে গুতা দিয়েছিল। বেদ্দপ গরুরে শিক্ষা দেয়ায় জন্য সে একটা প্রতিবাদি কার্টুন গরু আঁকল। সে ছবিতে গরুর শিং অনেক বড় আর মোটা আঁকলো। এতবড় শিং নিয়ে গরুর দাড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝানোর জন্য চোখ দিয়ে পানি পড়া দেখাল। তবে সব চেয়ে ইন্টারেস্টিং ছিল, গরু যাতে পেশাব করতে না পারে সেজন্য পেশাব দড়ি দিয়ে বেধে দেয়া আঁকল।



এখন এতসব কাজের ভেতর বাগান করা এবং তা নিয়ে নানান রকমের বই পড়া, নেট ঘেটে তথ্য দেখা আর তা কাজে লাগানোর ব্যাপার দেখা যাচ্ছে।

জানালার এ জায়গাটুকুতে সে বাগান করেছে। নিম, লিচু, কচু, নয়নতারা, পিয়াজ, মরিচ এবং কয়েক রকমের ঘাস আছে এখানে। গাছের একটা তালিকা করেছিল সে। সকাল-সন্ধ্যা পানি দেয়। কখনও টবে চা-পাতা দেয়।



বাগান করাটা এখন তার অন্যতম প্রধান কাজে পরিণত হয়েছে। আমরা তার এসব কাজে বাধা দেই না।

চিকু শেখ ভবিষ্যতে কি হতে চায়, তা জানার জন্য হয়ত আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

বৃহস্পতিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১২

টুংগীপাড়ার পথে......





সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।

এবার হঠাৎ বর্ষণমুখর দিনে জন্মভূমির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। যাত্রাবাড়ীর যানজট ছাড়া এবারের ভ্রমণটা ছিল এককথায় মন জুড়ানো। পুরো রাস্তা মখমলের মত মসৃণ আর আরামদায়ক। সাথে ক্যামেরা ছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় পর্যাপ্ত ব্যাটারি না থাকায় অনেক ছবি তোলা যায় নাই।



মাওয়া লঞ্চঘাট থেকে পদ্মায় ভেসেছি আমরা।



ঘাটের পাশেই ইটের ভাটা। নদীতে গরুর গা ধুইয়ে দেয়া আর নিজেরাও ডুব দেয়ার কাজ সারছে মাওয়া পাড়ের লোকেরা।



একটা ফেরিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই।



একটা লঞ্চও পেছনে পড়ে গেল।



অবশেষে কাওরাকান্দি ঘাটে পৌঁছে গেলাম।



পরিবহণটার সিটগুলো ছিল বেশ আরামদায়ক, আর একটু বৃষ্টিও নেমেছে, এজন্য কোন ফাকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নরম হাতের ধাক্কা।

-এই দেখো, গাড়ি জয়বাংলা পাম্পে থেমেছে। আমার একটু ইয়ে চেপেছে।

কি আর করা! আরামের ঘুমের বারটা বাজিয়ে টয়লেটের খোজে নামলাম তাকে সাথে নিয়ে। নগরকান্দার এ তেলের পাম্পটি সবাই জয়বাংলা পাম্প নামে চেনে, যদিও অন্য কি একটা নাম আছে।



হরিদাসপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সেতুর ওপর থেকে তোলা। গোপালগঞ্জ শহর এখান থেকে প্রায় দশ মিনিটের পথ।



ঘোনারপাড়ার কাছে চলে এসেছি। সোজা গেলে মোল্লাহাট সেতু দিয়ে খুলনা-বাগেরহাট-মংলা। ডানে গোপালগঞ্জ শহর। আমরা বামে যাবো।



টুংগীপাড়া হাইস্কুল। এখানে আসলে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অনেক মান-অভিমান আর স্মৃতি জড়িয়ে আছে।



এই সেই ঐতিহাসিক টুংগীপাড়া মোড়। হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা আর ভালবাসার মানুষটি ঘুমিয়ে আছে এখান থেকে সামান্য একটু দুরে। আপনাদের সবাইকে দাওয়াত এখানে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্য।

[ব্যাটারি ডাউন হওয়ায় শেষ ছবিটা ভাল ওঠে নাই]

হায় সুরুয়া..





একদিন সুরুয়া খেয়েছিলাম..
আসলে কথাটা হবে
খাইয়ে দিয়েছিলে...

তখন কেবল আমার
বসন্তের ফুল ফুটতে শুরু করেছিল
সেদিন জ্বরের ঘোরে কী বলেছি জানিনা
তারপর কতদিন পরি পরি বলে খেপাতে তুমি
কেউ জানত না পরিটা আসলে কে

এখনও পরি আছে
কেননা তুমি আছো
এখনও সুরুয়া খাওয়া হয় খুব

কেবল পরিকে দেখিনা
কুড়িটি বসন্ত



ছবি-নেট থেকে

অদ্ভুত সুন্দরের খোঁজে




সুন্দরকে উপলব্ধির অর্থ হলো
ভালবাসাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু দেখে নেয়া
যেভাবে কোনো শিল্পকর্ম বারবার ছুঁয়ে দেখলেও
পিয়াস থেকে যায়।

কখনো নিঃসঙ্গ দুপুরে দিঘীর জলে
শুকনো পাতার নিমজ্জন
কখনো বিকেলের নরম রোদে
ভালোলাগার অনবরত সংসক্তি।

আসন্ধ্যা কোন অদৃশ্য ইচ্ছায়
বুভুক্ষ থাকা
ফলাহার রসনাবিলাস আর
দেহসুখ সরিয়ে রাখা

কী সেই সুন্দরের তিয়াস
যে সৌন্দর্য হৃদয়ের কাছে হার মানে না?
দেহের সব ইচ্ছার কাছে পরাভূত নয়?

মূলত বৃষ্টির অঝোর ধারায়
ধুয়ে যায় যে পঙ্কিলতা
অদ্ভুত সুন্দরের খোঁজে
এ কৃচ্ছসাধনা।


ছবি- নেট থেকে

জানি সে আছে




আমি জানি আছে
তার নম্বরটাও আছে সেভ করা
সে আছে তার চারপাশ আলো করে
শুধু একা হলে হাহাকার ওঠে
অন্ধকার চিরে

এইতো সেদিন মুঠোফোনে
উচ্ছল কলরোল, বাধভাঙ্গা আশা
স্বপ্নপাখির ডানায় শুধু
সবুজের আশা

কৈশোর ঝলমল মুখখানা ভাসে
আহা! এই মন তোরে দেখি
ভেদবুদ্ধি গেল নাশে

এখনও খুব ভোরে হঠাৎ জেগে
হু হু করে মন
ভাবি বসে ঝিম মেরে
এই বুঝি বেজে ওঠে ফোন

জানি নিজেকে বেধেছে সে
নিঠুর মায়ায়
চারপাশ হৈচৈ ছুটে চলা পথ
ভয় শুধু কখন
একলা পহর আসে
মেঘলা ছায়ায়
আমি জানি সে আছে

সেও জানে আমি আছি
খুবই কাছাকাছি

বিভ্রান্ত করে কি লাভ!!!



জ্ঞান নিয়ে অজ্ঞানী কারবার।

আমরা মনে করি, একটা বিষয়ে কোন উদ্দেশ্যে এই জ্ঞান জিনিসটাকে যদি উল্টে-পাল্টে দিতে পারি, তাহলে আম পাবলিকরে একটা অজ্ঞানী ঘুটা খাওয়ানো যাবে।

কিছু লোকরে হয়ত করা যায়। কিন্তু সবাইকে নয়। কেউ বিষয়টা সাথে সাথে ধরে ফেলেন এবং দাত কেলানো হাসি দেন।

কুরআন-হাদিসের কথাগুলো আরবিতে এসেছে আমাদের কাছে। আমরা অধিকাংশ এই ভাষাটা জানিনা বলে কিছু জ্ঞানপাপী আমাদের বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেন।

এই ব্লগে এমন কিছু কারবার আছে। কেউ আবার নবী হয়ে প্রেরণাবাণী নাযিল করেন। আমরা কেউ কেউ শুধু দাত কেলাই।

বিনোদন একটি ভাল জিনিস। কিন্তু অতিরিক্ত হলে তাতে বদহজম হয়।

এক ব্লগার আরেক ব্লগারকে ভন্ড বলে যে পোস্ট দিয়েছেন তাতে বদহজমের সমূহ আশঙ্কা আছে।

উস্তাদের কাছে ইলম অর্জনের জন্য গিয়েছি, তিনি একটি ফার্সি কবিতা দিয়ে শুরু করলেন।


ইলমে রা হারগেজ না ইয়াবি তা না গীরে সসখেসাল
হেরসে কোতা ফাহমে কামেল জময়ে খাতের কুল্লি হাল
খেদমতে ওস্তাদে বায়াদ হাম সবক খানি মোদাম
লফজে রা তাহকিকে কুনি তা সুয়ে মরদে কামাল।




ইলম অর্জনের জন্য ছয়টি গুন ধারণ করতে হয়।
এক. প্রচন্ড আগ্রহ
দুই. পরিপূর্ণ অনুধাবন
তিন. সবার সাথে সদ্বভাব বজায় রাখা
চার. ওস্তাদের খেদমত করা
পাঁচ. পাঠ তৈরি রাখা
ছয়. প্রতিটি শব্দের বিশ্লেষন করা

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বললেন,

বেআদব, অহঙ্কারী, গোঁয়ার বা একগুয়ে লোকেরা ইলম বা জ্ঞান দিয়ে কারো উপকার করতে পারে না, নিজেও উপকৃত হয় না।

রমজান মাস। সংযমের মাস।
রোজা রেখে এই কথাগুলো না বললেও হত। তবু বলতে হল বলে দুঃখিত।

সবাইকে রমজানের শুভেচ্ছা


ছবি-নেট থেকে

আত্মশুদ্ধির সময় এলো আবার



গত দু'তিন দিন ধরে নিজকে রোজাদার মনে হচ্ছে। মাগরিবের আজান শুনে ইফতারির কথা মনে ভেসে ওঠে। শেষরাতে আজান শুনে ধড়মড়িয়ে উঠি। সেহরি খাওয়া হলোনা!

আসলে রমজান শুরুর আগে প্রতি বছরই এমন অনুভূতি শরীর-মনে জড়িয়ে ধরে। বিশ্বাসের এই দোলা দিয়ে যাওয়াকে কিভাবে ব্যক্ত করা যায়।

রোজার প্রস্তুতিও নিজের অজান্তে এগিয়ে চলে। পুরনো বই-কেতাব আর নেট ঘেটে মছলা-মাছায়েল পড়ি।

কুরআন পাঠ চলে। রোজার আয়াতগুলো বারবার পড়ি। মনে একধরণের শান্তির পরশ লাগে।


রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহ তা’আলার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।
সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫

আজ জুমার দিন মহল্লার মসজিদে মুসল্লির সমাবেশটা উপচে পড়ার মত। আমার কাছে এটা একটা উৎসব উৎসব মনে হয়। অন্য জুমায় নিয়মিতদের দেখেছি। আজ শিশু-যুবক-প্রবীনদের জোয়ার সেখানে। যুবকদের সংখ্যা গতবারের তুলনায় বেশি মনে হল। হাজারের বেশী মুসল্লি রাস্তায় জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ল। ইয়াংদের কয়েকজন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, রোজা আইছে, আকাম-কুকামডা অফ রাখতে হইব। রোজায় ভাল কামের লগে যেন ভেজাল না মেশানো হয়।

এমন সব সরস মন্তব্য।

আমার কাছে কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ আয়াতটা পড়ে নিজেকে শুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা পাই বারবার।

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।


আজ প্রথম তারাবি পড়ার পর খুব ভাল লাগছে।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। সবাই সেহরি খেতে বসেছে। আমাকে ডাকা হয়নি। আমি হঠাৎ জেগে উঠেছি। ডাকা হয়নি বলে মুখভার করে সেহরি খেতে গিয়েছি। মা বলেন, খোকা তুমি এখনও অনেক ছোট। রোজা রাখার সময় হয়নি তোমার। আমি গাল ফুলিয়ে বলেছি পাশের বাড়ির আবির-শায়লারা কি আমার থেকে বড়! মা হেসে দিয়েছেন। বাবা পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, খোকা, রোজা শুধু না খেয়ে থাকা নয়। গরীব-দুখীর কষ্ট অনুভব আর মন্দ থেকে দূরে থাকার ট্রেনিংও বটে।

আহা! সেসব কথা রোজা এলে এখনও খুব মনে পড়ে। শুধু সেই হাসিমুখ আর স্নেহের হাত নেই পাশে।

সবাইকে রমজানের শুভেচ্ছা।



ছবি- নেট থেকে।

ঢাকা- এশিয়া অঞ্চলের ইসলামিক সাংস্কৃতিক রাজধানী-২০১২




গিয়েছিলাম শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রদর্শনী দেখতে। আহ..প্রাণ জুড়িয়ে গেল! শিশুরা এত সুন্দর করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি একেছে, যা ভাষায় বর্ণনাতীত। আরো অসংখ্য ডকুমেন্টের ফটো রয়েছে সেখানে।

নিচে নেমে দেখি অফিসের সামনে বেশ বড়সড় জটলা। কারণ আর কিছুই না, ১৪ জুলাই ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী উদ্বোধন হবে। ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং জমা করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, আইসেসকো(Islamic Educational, Scientific and Cultural Organization (ISESCO) ঢাকাকে ২০১২ সালের জন্য এশিয়া অঞ্চলের ইসলামী সংস্কৃতির রাজধানী ঘোষণা করেছে।



এই উপলক্ষে ব্যাপক আয়োজনও করা হয়েছে।

খুইজা দেখি কয়েকটা ক্যালিগ্রাফি নেটে ছাড়া হয়েছে।


কালিমা তৈয়্যবা


বেঙ্গল তুগরা


ভালবাসা


রক্ষা

এগুলো সব ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীমের আঁকা।

রবিবার, ১৫ জুলাই, ২০১২

ইসলামী ক্যালিগ্রাফি : প্রবাহমান এক শিল্পধারা



বিশ্বব্যাপী মুসলিম এবং ইসলামী সংস্কৃতি আজ এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ তার বহুদূর বিস্তৃত ফুলের ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে। ডালপালাগুলোতে বহুবর্ণের ফুলের মতো মুসলিম স্থপতি, শিল্পী, লেখক এবং চিন্তাবিদ-গবেষকগণ তাদের মহান ঐতিহাসিক ঐতিহ্যিক নিদর্শনকে নবরূপে, নতুন সাজে প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত করে চলেছেন। তাদের এই কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দীপনা ও প্রবাহকে আল হাল্লাজের রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক কবিতার মত তুলনা করা যায়। অথবা প্রাচীন হিব্রু চিত্রকলার ঐতিহ্যিক রং ব্যবহারের মত ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে একাধারে শৈল্পিক বোধ, ঐতিহ্য, রংয়ের বিচিত্রতা এবং প্রতিনিয়ত শিল্পময় আবিষ্কারের ভাবনা নতুন নতুন সৌন্দর্যময় আবহ ও আক্ষরিকভাবেই নতুন দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছে। শিল্পের মহান গবেষকগণ, বিশেষ করে ইসলামিক আর্টের সাথে যারা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছেন। মুসলিম-অমুসলিম সব শিল্পবোদ্ধাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “মহান ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মিউজিক বা সঙ্গীতের মত। এটা আয়ত্ত করতে হয় তীক্ষ্ণ মনসংযোগ নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য সাধনা ও নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বিধি মেনে চলে।” প্রতিদিন গলা সাধার মত ক্যালিগ্রাফির কলম দিয়ে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হয়। হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফির গুপ্ত কৌশলগুলো শিখে নিতে হয়। ওস্তাদ যদি সূক্ষ্ম কৌশল দেখিয়ে না দেন তাহলে আক্ষরিক নিপুণতা বলতে যা বোঝায় সেটা আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য খাগের কলম কাটা এবং সেটা দিয়ে হরফকে স্বাচ্ছন্দ্যে লেখা সম্বন্ধে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক কাজী আহমদ যর্থাথ মন্তব্য করেছেন। তিনি কলমের প্রতীক এভাবে বর্ণনা করেছেন, “মানবের কাছে প্রভুর দেয়া সব জ্ঞানের বাহন হচ্ছে কলম।”

[লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে। দুই ভাগে দিলে ভাল হত। আগাম সরি জানাইলাম।]

আরবী ক্যালিগ্রাফি যেসব দেশে প্রধান শিল্পকলাররূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৫ শতক অথবা ১৬ শতক পর্যন্তও পেইন্টিংয়ে তা অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে পশ্চিমা শিল্পকলায়। কিন্তু ইসলামী ক্যালিগ্রাফির স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ প্লাস্টিক বা নমনীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, তরঙ্গমালার মত পুনরাবৃত্তি বা রিপিটেশন প্রয়োগ বিধি এটাই প্রমাণ করে যে, আরবী ক্যালিগ্রাফি তার এসথেটিক বা সৌন্দর্য দর্শন বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম। আর বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ের ইতালীয় পেইন্টিং বাইজেন্টাইন শিল্প কর্মগুলো এমনকি মধ্যযুগের ফরাসি গির্জা যেমন লা- পোতে আরবী নক্সাকলা, ক্যালিগ্রাফির জোরালো প্রভাব রয়েছে, কোথাও কোথাও হুবহু প্রয়োগও করা হয়েছে। এসব মটিফ বা সুন্দর নমুনাগুলো আরবী ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য দর্শনের চূড়ান্ত পর্যায় মেনে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করেন।

আরব সভ্যতার উত্থানের পেছনে যে উপাদানগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে প্রথমত-কুরআন, দ্বিতয়ত-ইসলাম পূর্ব কবিতা এবং চূড়ান্ত প্রর্যায়ে ক্যালিগ্রাফি ও স্থাপত্য। আরবী ক্যালিগ্রাফির গাঠনিক আকৃতি রূপদানকল্পে আরব ক্যালিগ্রাফারগণ জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন। এর সাথে আধ্যাত্ম অনুভব, ভাষার প্রতি একান্ত ভালবাসা ক্যালিগ্রাফির উৎকর্ষতা প্রদানে ভূমিকা রেখেছে। সারাবিশ্বে লিপিমালার শিল্পময় স্থান তুলনা করলে, অবধারিতভাবে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শীর্ষস্থান দখল করবে। ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা, সৌন্দর্যময়তা প্রদানের অত্যাগ্রহ ও পিপাসা, বিশ্বাসের প্রতি অঙ্গীকার, ধর্মীয়ভাবে তীক্ষ্ণ শিল্পবোধ সম্পন্ন ক্যালিগ্রাফারদের কঠোর সাধনা ও আত্মনিয়োগের ফলে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিশ্বখ্যাত মর্যাদায় আসীন হয়েছে।

পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে মূলত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির দ্রুত বিকাশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হাতে লিখে কুরআনের কপি করা হতো। ইসলামে সমাজ, ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুই কুরআন আবর্তিত। সুতরাং মুসলিম সভ্যতা কুরআনকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে। একে যতভাবে পারা যায় সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। একজন ক্যালিগ্রাফারের অধীনে বহু নক্সাকার ও কাতিব নিয়োজিত থাকতেন কুরআন কপি করার জন্য। ক্যালিগ্রাফার যাকে আরবিতে খাত্তাত বলা হয়, তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, যাতে প্রতিটি কুরআনের কপি যেন অনন্য সৌন্দর্যের আকর হয়। প্রতিটি হরফ, আয়াত, সূরার শিরোনাম, হাসিয়া বা পার্শ্বটিকা, বর্ডার অলংকরণ সবকিছুতেই ক্যালিগ্রাফার পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর দিতেন। দৃশ্যগত শিল্পে বিশেষ করে শিল্পকলায় শৈল্পিক ভিত্তি বা দর্শন গ্রহণের ক্ষেত্রে মেকি বা কৃত্রিম উপাদান-মটিফ, প্রিন্সিপল বা বিষয়গত সংযোজনা সৌন্দর্য দর্শনে প্রাকৃতিক উপাদানকে আবর্তিত করে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ফর্মের সবচেয়ে সার্থক ব্যবহার, প্রয়োগ ও কৌশলগত উপস্থাপনা মুসলিম ক্যালিগ্রাফারগণ স্বাচ্ছন্দ্যে করে থাকেন।

হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফি এসথেটিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছে। শিল্পময় উপস্থাপনাকে আপোসহীন মনোভাব নিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। কখনই ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে নান্দনিকতা ও হরফের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য সামান্যতম অবহেলা পাইনি। সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফারগণ কোন ছাড় দিতেন না। হরফের উপস্থাপনা যেন কাব্যিক অনুভব এনে দেয় তার জন্য রাতের পর রাত নির্ঘুম অনুশীলনী ও চর্চা অব্যাহত রাখতেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা। হরফের মসৃণতা, আকৃতি, সেপ ও সাইজ, গতি প্রকৃতি এবং স্টাইলের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়টি তাদের কাছে জীবন মৃত্যু পথের অনুভব এনে দিত। উদাহরণ স্বরূপ আলিফের মাথা বা রা’স ঠিকমত হচ্ছে কি-না তার জন্য দিস্তা দিস্তা কাগজ আর অসংখ্য দোয়াত খালি হয়ে যেত। কারণ, এই রা'সের ওপরেই পুরো হরফমালা আর স্টাইল নির্ভর করে।

নির্ভুল আর নিখুঁত হরফ লিখতে যে রকম অনুশীলন ও ধৈর্য দরকার, প্রতিবার যেন এই রকম হরফটি হয় সে চর্চাও চলত অবিরাম। প্রচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরবী ক্যালিগ্রাফিতে মাস্টার ক্যালিগ্রাফারগণ একাধারে কুরআন কপি ও অনুশীলনপত্র, যাকে আরবিতে “তাসউদ” এবং তুর্কী ভাষায় “কারালামা” বলে, তা তৈরী করবেন এবং সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফারদের মূল্যায়ন ও একত্রিত করার প্রয়ার চালাবেন। সমাজে তিনি ক্যালিগ্রাফিকে সাংস্কৃতিক আবহের মূল উপাদানে শামিলের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। এ সময়ের সমকালীন ইসলামী ক্যালিগ্রাফির যে স্কুল বা ধারাটি বিশ্বব্যাপী প্রবল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তা হচ্ছে বাগদাদের স্কুলটি। হাশিম মুহাম্মদ আল খাত্তাত আল বাগদাদী এবং ওসমানীয় শাসনামলের প্রাথমিক ওসমানীয় স্কুল যেটা শেখ হামাদুল্লাহ আল আমাসীর “নিও ক্লাসিক্যাল” যাকে কৌশল, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগিক দক্ষতাকে ৮ম শতাব্দী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় দাঁড় করিয়েছে।

সমকালীন ক্যালিগ্রাফিতে যে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে তা হচ্ছে, ট্রেডিশনাল ধারাকে আত্মস্থ করে আধুনিক শিল্পকলায় তা নতুনভাবে উপস্থাপন করা। বিশেষ করে পেইন্টিংয়ে নক্সাকলার সতর্ক ও সচেতন, বলা যায়, অতি সংবেদী উপস্থাপনা যেন ক্যালিগ্রাফিকে ছিটকে না ফেলে।

উল্লেখ্য, ট্রেডিশনাল ক্যলিগ্রাফিতে এ্যারাবেস্ক বা আল যুখরুফাহ আল আরাবিয়া অর্থাৎ আরবী নক্সাকলা প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সেক্ষেত্রে আধুনিক চিত্রকলার আরবী নক্সাকলার নির্বাচিত এবং সূক্ষè শিল্পবোধকে উদ্দীপ্ত করে এমন মোটিফ ক্যালিগ্রাফিতে ব্যবহার করা চলে। যেমনভাবে ইমেজকে ক্যালিগ্রাফি সাথে সমন্বয় করতে দেখা যায়। তবে ভিজ্যুয়াল ইমেজের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বর্তায়। যেখানে ইমেজ ক্যালিগ্রাফির ওজনকে খর্ব করে কিংবা ইমেজটা মূখ্য হয় সেখানেও পরোক্ষভাবে ক্যালিগ্রাফির পবিত্রতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে ডেকো আর্ট, যেখানে ক্যালিগ্রাফিতে মটিফ না এনে বর্ডারে, মাউন্টে নক্সা প্রয়োগ করা হয়। সেক্ষেত্রেও সৌন্দর্য দর্শনকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে বিখ্যাত মার্কিন ক্যালিগ্রাফার এম.জে. আল হাবিব মনে করেন।

ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি সাদা বা হালকা রং দিয়ে করা হয়। ফোরগ্রাউন্ড বা হরফ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাঢ় বিশেষ করে কালো রং দিয়ে করা হয়। নক্সা, মোটিভ কিংবা নুকতা বা ফোঁটাগুলো যাতে ছন্দ হারিয়ে না ফেলে সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়। আধুনিক পেইন্টিংয়ে পারস্পেকটিভ, স্পেস, রংয়ের ব্যাকরণ, সর্বোপরি শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ ও দর্শনকে উপস্থাপন করতে ট্্েরডিশনাল মোটিফের স্বাচ্ছন্দ্য অংশকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্যানভাসের পটভূমিতে মূখ্য বিষয়কে উপস্থাপনে কোন আয়াতাংশ, শব্দ, হরফকে প্রধান্য দিতে গিয়ে পুরো টেক্সকে ক্ষুদ্রাকৃতি করে প্রয়োগ করা হয়। কিংবা এমনভাবে টেক্সচারকে রংয়ের ভেতর প্রয়োগ করা হয় যাতে শৈল্পিক আবহ আরো জাঁকালো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হরফ ও পটভূমি মনোক্রমিক রংয়ের হয়ে থাকে, তবে ক্যালিগ্রাফিকে কৌশলে প্রাধান্য দেয়া হয়।

আধুনিক ক্যালিগ্রাফিতে ক্যালিগ্রাম বলে একটি ধারা চালু হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফারগণ এটা শুরু করলেও পশ্চিমা বিশ্বে এখন বেশ জনপ্রিয়। কালো কালির প্রক্ষেপনে বিভিন্ন ফিগার, বিশেষ করে পোট্রেটকে হরফ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বর্তমানে আরব আমিরাতে অবস্থানকারী ক্যালিগ্রাফি শিল্পী খলিলুল্লাহ ক্যালিগ্রামকে বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছেন। এটা মূলত তুগরা বা জুমরফিক ক্যালিগ্রাফিরই একটি শাখা।
স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারা বিশ্বব্যাপী নব নব আঙ্গিকে প্রয়োগ হচ্ছে। তুরস্কে ট্রেডিশনাল ধারার শীর্ষ কাজগুলো রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির বিচিত্র প্রয়োগ জোরেশোরে চালু হয়েছে। সৌদি আরবে বড় শহরগুলো সৌন্দর্যবর্ধনে ক্যালিগ্রাফিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কাজে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক ফর্ম ও কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য প্রধানত দু’ধরনের। এক. শৈলী ভিত্তিক বা ট্রেডিশনাল দুই. পেইন্টিং নির্ভর।

শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি এসে যায়। আক্ষরিক অর্থে শৈলী বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ দাবী করে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও শিল্প সমালোচকদের ওপর। শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন যেহেতু শিল্প সমালোচকরা করে থাকেন, এজন্য ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে সমালোচকদের দায় দায়িত্ব একটু বেশী রয়েছে বলে মনে করি। শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এদেশের প্রচলিত আরবী হরফ সম্পর্কে সাধারণের মাঝে যে ধারণা রয়েছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

এ দেশের জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশ আরবি হরফ বলতে কোলকাতা ছাপার কুরআনের হরফ বুঝে থাকেন। এই হরফ মূলত: নিশ্চল বা গতিহীন টাইপ সেট। এতে হাতের লেখার জীবন্ত প্রবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও খুব সীমিত পরিসরে লৌখনু ছাপার কুরআন রয়েছে, তবু তা অধিকাংশের কাছে পাঠ করা কঠিন বলে অনুযোগ রয়েছে। সুতরাং শৈলী বিষয়ক নন্দন তত্ত্বের আলোচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবী হরফের শৈলী বিষয়ক বিশুদ্ধতা যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেটা আরব দেশসমূহে বিশেষ করে তুরস্কে রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মগুলো যা গত তিন দশক ধরে শিল্পীগণ করেছেন। তার শৈলী ভিত্তিক বিবেচনা দেশীয় আঙ্গিকে যথেষ্ট আশাপ্রদ। এ কথা এজন্য বলা হচ্ছে, কারণ পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীর উৎকর্ষতা উন্নীত এবং আন্তরিক। নিবেদিত প্রাণ শিল্পীগণ একক ও দলগত প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন। বিদেশের ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাদের সরব অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত। ২০০৭ সালে তুরস্কের আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে ৫ জন শিল্পী, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা নুরুল্লাহ, মোরশেদুল আলম, মাসুম বিল্লাহ ও সিদ্দিকা আফরিন লামিয়া অংশগ্রহণ করেন। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের সদস্য। যেহেতু প্রতি বছর আয়োজিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে শৈলীগত সৌন্দর্যরূপের পরিবর্তন হচ্ছে তাই সাম্প্রতিক শিল্পকর্মের এবং ৩ দশক আগের শিল্পকর্মের শৈলীগত পার্থক্য বেশ বড় ধরনের। সাম্প্রতিক ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মগুলোতে শৈলীর উৎকর্ষতা চোখে পড়ার মত। হরফের গতি প্রকৃতি, বিভিন্ন ফন্টের নিপুন উপস্থাপন, কম্পোজিশনে নতুনত্ব, এমনকি সাম্প্রতিক মুয়াল্লা শৈলীর বেশ কয়েকটি মান সম্মত কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপ বা দর্শন কি? কয়েকটি বিষয় এর সাথে জড়িত, হরফের সঠিক সেপ ও সাইজ যেটা আল খাত আল মানসুব বা আনুপাতিক লেখনীর সাথে সম্পৃক্ত এবং ইবনে বাওয়াবের মানসুব আল ফায়েক অর্থাৎ সৌন্দর্যময় লেখনী আক্ষরিক অর্থে আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমীর কলম কাটার কলাকৌশল এতে পূর্ণতা এনেছে, কালির প্রস্তুতবিধি, ব্যবহার নীতিমালা, কাগজ বা উপায়-উপকরণ একটি নির্দিষ্ট বিধিমালার অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সুলুস লিপির আলিফটি ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লিখতে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। র’স বা মাথা হবে দেড় থেকে দুই ফোটা বা নোকতা বরাবর এবং জেসম বা শরীরটি ৫-৬ নোকতা বরাবর লম্বা হবে। শেষে মাথার নীচে কলমের ডান কোনা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এটা হল সাধারণ নিয়ম কিন্তু হরফের আকৃতি ও পরিমাপ ঠিক রাখার সাথে সাথে এর রৈখিক বাঁক ও ভাজগুলোও যথাযথ করতে হয়। এটি সরাসরি নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট যেটা হাতে-কলমে ওস্তাদ ছাত্রকে শিখিয়ে থাকেন। দর্শককেও এ বিষয়ে হাতে-কলমে আত্মস্থ করতে হয়। আর ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়ে আসছে ১৯৯৮ সাল থেকে। যেজন্য নবীন ক্যালিগ্রাফারদের বৃহৎ অংশটি শৈলীতে দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছে।

বাংলাদেশে শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি যারা চর্চা করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ এফ. বারী, বসির মেসবাহ, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা, নেসার জামিল প্রমুখ। আরিফুর রহমানের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে খাগের কলমের সরাসরি প্রয়োগ অনুপস্থিত। কিন্তু তিনি শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির প্রতি যত্নশীল। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে সুলস, নাসখ, দিওয়ানী, কুফী, রুকআ, নাস্তালিক, রায়হানী, মুহাক্কাক, ও মুয়াল্লা শৈলীর উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। রঙের মাধ্যম হিসেবে পানি রং, কালি, এ্যাক্রিলিক, তেল রং মেটাল রং প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাগজ, ক্যানভাস, কাঠ, পাথর, ধাতব মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি করা হয়ে থাকে।

চিত্রকলায় যেমন শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন রয়েছে তেমনি স্থাপত্যে বিশেষ করে মসজিদ গাত্রে আরবি ক্যালিগ্রাফি ইদানিং বাংলা ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক উপস্থাপন দেখা যায়। শিল্পী আরিফুর রহমান ২০০২ সালে কুমিল্লার গুনাই ঘর ও ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ বরিশালের গুঠিয়ায় ২টি মসজিদে বাংলা-আরবীতে শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেছেন। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পতেঙ্গায় সলগোলা জামে মসজিদ, ২০০৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার, সুন্ধিসার জামে মসজিদ, ২০০৫ সালে ঢাকা সেনানীবাসে সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদ, ২০০৪ সালে বারিধারা ডিওএইচএস মসজিদ, ২০০৬ সালে ঢাকা উত্তরার ৫নং সেক্টর জামে মসজিদ, ২০০৭ সালে হবিগঞ্জে শাহ সোলেমান ফতেহ গাজী (রহ:) দরগাহ-এ এবং ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পুরান ঢাকায় হোসেনী দালানে সুরা আর রাহমানের শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেন। ২০১১ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে শরীফপুর জামে মসজিদে টেরাকোটা ও রিলিফ পদ্ধতিতে সুরা আর রাহমান এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফি করেন। এসব স্থানে কুফি, সুলস, বেঙ্গল তুগরা, নাসখ, দিওয়ানী প্রভৃতি শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ এফ. বারীসহ কয়েকজন শিল্পী বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদ, ধর্মীয় ইমারতে ক্যালিগ্রাফি করেছেন।
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বৃহত্তম অংশ হচ্ছে পেইন্টিং নির্ভর। আর এই পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে প্রবীন ও খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের শিল্পকলার পেইন্টিংয়ে কিভাবে ক্যালিগ্রাফির সার্থক উপস্থাপন হতে পারে তা দেখিয়েছেন তিনি। তাকে বাংলাদেশের পেইটিং ক্যালিগ্রাফির পথিকৃত বলেছেন শিল্পবোদ্ধারা। প্রবীণ শিল্পী আবু তাহের, মরহুম শামসুল ইসলাম নিজামী, সবিহ-উল আলম, ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহিম মণ্ডল, আমিনুল ইসলাম আমিনসহ অর্ধ শতাধিক প্রবীণ নবীন শিল্পী আরবী-বাংলা হরফকে অনুসঙ্গ করে অসাধারণ সব ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করে চলেছেন। শিল্পী আবু তাহের অর্ধবিমূর্ত ঢংয়ে পেইন্টিং করে থাকেন। আরবী হরফের পরস্পর ছন্দ ও গীতিময়তা একটি টান টান আকুলতা নিয়ে ফুটে ওঠে তার শিল্পকর্মে। রং, ফর্ম ও রেখার আশ্চর্য সম্মিলন দেখা যায় তার ক্যালিগ্রাফিতে। শিল্পী সবিহ-উল আলমের ক্যালিগ্রাফিতে ত্রিমাত্রিক ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। শিল্পী ড. আব্দুস সাত্তারের ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচ্যকলার আবেশ মূর্ত হয়ে ওঠে। সাইফুল ইসলাম নিজস্ব স্টাইল ও রংয়ের সমন্বয়ে এক ভিন্ন জগত তৈরী করেছেন। তার ক্যালিগ্রাফিতে তাই নাগরিক ক্যালিগ্রাফির মূখরতা দেখা যায়। ইব্রাহীম মণ্ডলের ক্যালিগ্রাফিতে বাংলার নিসর্গ, ফর্ম ও রেখার সাথে রঙের উজ্জ্বল্য উপস্থিতি দশর্ককে আকর্ষণ করে। আমিনুল ইসলাম আমিন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বাস্তব জগতের সাথে আধ্যাত্মিক ক্যালিগ্রাফির সমন্বয় তুলে ধরেন তার শিল্পকর্মে। নিপুন তুলির ছোঁয়ায় তার শিল্প ভাস্বর হয়ে ওঠে।



এছাড়া আরো খ্যাতনামা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী রয়েছেন, যেমন- আমিরুল হক, মাহবুব মুর্শিদ, ফরেজ আলী, রেজাউল করীম, রাসা প্রমুখ তাদের ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ও ভাষ্কর্য চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি অঙ্গনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে হরফ যেহেতু অনুসঙ্গ হয়ে আসে, সেক্ষেত্রে শৈলীর উপস্থাপন হয় গণ্য। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে শৈলীও সমানভাবে পেইন্টিংয়ে উঠে আসে। তবে সেটা সংখ্যায় একেবারে হাতে গোনা। মূলত: পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে রং, ফর্ম, দর্শন চিন্তা, ব্যাকরণ প্রভৃতি লক্ষ্য রাখা হয়। পেইন্টিংয়ে শিল্পকর্ম হতে গেলে যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন শিল্পী সেদিকে গভীর দৃষ্টি রাখেন। ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে প্রায় সব শিল্পকর্মে এমন উপস্থাপন লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে পবিত্র কুরআন হাদিসের বাণী মূখ্য হয়ে আছে। এর সাথে শুধুমাত্র হরফের কম্পোজিশন যেমন আরিফুর রহমানের আলিফ বিন্যাস, ইব্রাহীম মণ্ডলের আলিফ নৃত্য শিল্পকর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাংলালিপি নির্ভর বহু উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান সহ অধিকাংশ শিল্পী তাদের শিল্প চর্চায় বাংলা ক্যালিগ্রাফিকে সযতেœ লালন করেছেন। এসব শিল্পকর্মে হরফের প্রান্তীয় স্ট্রোকগুলো প্রলম্বিত করে এবং কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে হরফকে ভেঙ্গেচুরে সমন্বয় ও ছন্দায়িত করার প্রয়াস চালানো হয়। অনেক শিল্পী তাদের কাজে বাংলা ক্যালিগ্রাফির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য না দিয়ে আরবী কুফি, সুলুস প্রভৃতির আদলে করতে চেয়েছেন, এতে অনেক শিল্পবোদ্ধা ভিন্ন মতামতও ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পেইন্টিংয়ে যে বাংলা ক্যালিগ্রাফি দেখছি সেটা ৯০ দশকের শেষ দিকেও তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প আক্ষরিক অর্থে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তিন দশক পর এই শিল্পের পথ চলায় প্রয়োজনীয় উপাদান উপকরণ যেমন সহজ লভ্য হয়েছে। তেমনি এর প্রতিষ্ঠায় একটি মজবুত ভিত্তিও পেয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে জানার জন্য বইপত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ সম্পর্কে ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের এখন দেখা মেলে। একটা কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিগত প্রয়াসকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিতে হয়। সেই সাথে যারা এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাদের অবদানও কম নয়। লেখালেখি, গবেষণার মাধ্যমে এ শিল্পের ইতিহাস সংরক্ষণ গতি প্রকৃতি মূল্যায়ন ও সবার কাছে এর পরিচয়, সৌন্দর্য, গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তুলে ধরার জন্য নিরলস সাধনা যারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অবদান যেন আমরা ভুলে না যাই। এদেশে ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন, প্রসার ও জনপ্রিয় করতে ইতোমধ্যে যে রচনা সম্ভার ও বইপত্র প্রকাশ পেয়েছে তা নিতান্ত কম নয়। শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদনের সাথে বাংলাভাষায় এর ইতিহাস ক্রমধারা, শৈল্পিক বিশ্লেষণ নিয়ে গ্রন্থও রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ওপর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিও নিচ্ছেন অনেকে।

ক্যালিগ্রাফির এই বিস্তৃতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেশ লক্ষণীয় প্রভাব পড়েছে। ৮০ দশকের গোড়ার দিকে ক্যালেন্ডারে সিনেমার নায়িকা ও নারীচিত্র প্রধান উপাদান ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ক্যালিগ্রাফি, মসজিদ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীই একচ্ছত্র স্থান দখল করে চলেছে। সরকারি বেসরকারি ইমারতে ইন্টেরিয়র সজ্জায় ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম বড় ধরনের স্থান করে নিয়েছে। এমন কি বিদেশে সরকারি উপহার সামগ্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম গুরুত্ব লাভ করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে বহু ইমারতে ক্যালিগ্রাফি মুরাল, ফ্রেস্কো প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফির যে বিস্তৃতি, তার মূল্যায়নে দেশের প্রথিতযশা কয়েকজন শিল্পীর মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি। শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, আমি একজন পেইন্টারের দৃষ্টি দিয়ে এটা বলতে পারি অক্ষর দিয়ে পেইন্টিং করার একটি প্রয়াস এখানে রয়েছে যাতে ক্যালিগ্রাফি ছাপিয়ে নান্দনিক রসের অনুভব আমরা পেতে পারি। শিল্পী আবু তাহের বলেন, বেশ কিছু শিল্পী গভীর মমত্ব ও আনুগত্য নিয়ে ক্যালিগ্রাফি চর্চায় মনযোগ দিয়েছেন এবং আনন্দের বিষয় এদের মধ্যে কেউ কেউ শিল্পবোদ্ধাদের মনে গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। শিল্পী সবিহ-উল আলম বলেন, ১৬২টি ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম নিয়ে ৬ষ্ঠ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ২০০৩ গুণে মানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটা নি:সন্দেহে যেমন আনন্দের তেমনই গৌরবের। স্পেন প্রবাসী বাংলাদেশী শিল্পী মনিরুল ইসলাম ক্যালিগ্রাফিকে মিস্ট্রিক্যাল ফর্ম উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য তিনি শিল্পীদেরকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। ১২তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রান্ড প্রাইজ প্রাপ্ত ইরানের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সিদাঘাত জাব্বারী বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এজন্য তিনি ক্যলিগ্রাফী প্রদর্শনীগুলোর আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীও বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির প্রশংসা করেছেন এবং উত্তরোত্তর উন্নয়ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

ক্যালিগ্রাফি চর্চা বাংলাদেশে এখনো সেইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করেনি। শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ কোর্স, ওয়ার্কশপ, ডেমন্সট্রেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত কিংবা আলাদা ফ্যাকাল্টিও হতে পারে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য একটি স্থায়ী গ্যালারী এখনো নেই। তবে এরও ব্যবস্থা হয়ে যাবে এমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ক্যালিগ্রাফি আর্কাইভ গড়ে উঠছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যে আয়োজন ও উপায়-উপকরণ ও ভিত্তির প্রয়োজন, তার বহুলাংশ ইতোমধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে।



১৪ জুলাই ২০১২ শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারীতে ৩২ শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকাকে ২০১২ সালের এশিয় অঞ্চলের রাজধানী উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীতে আইসেসকো'র ডিরেক্টর জেনারেল ড. আবদুল আজিজ ওসমান আলতুআইজরি শিল্পকর্ম আগ্রহ নিয়ে দেখেন এবং শিল্পমানে অতুলনীয় বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বলিষ্ঠ শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এগিয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল ও কুসুমাস্তীর্ণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার যেমন গুরু দায়িত্ব রয়েছে তেমনি রাজকীয় শিল্পকলা হিসেবে সরকারের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার দাবি রাখে। বিষয়টিকে বিবেচনার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানাই।

ছবি-নেট থেকে

ইসলামী ক্যালিগ্রাফি : প্রবাহমান এক শিল্পধারা



বিশ্বব্যাপী মুসলিম এবং ইসলামী সংস্কৃতি আজ এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ তার বহুদূর বিস্তৃত ফুলের ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে। ডালপালাগুলোতে বহুবর্ণের ফুলের মতো মুসলিম স্থপতি, শিল্পী, লেখক এবং চিন্তাবিদ-গবেষকগণ তাদের মহান ঐতিহাসিক ঐতিহ্যিক নিদর্শনকে নবরূপে, নতুন সাজে প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত করে চলেছেন। তাদের এই কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দীপনা ও প্রবাহকে আল হাল্লাজের রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক কবিতার মত তুলনা করা যায়। অথবা প্রাচীন হিব্রু চিত্রকলার ঐতিহ্যিক রং ব্যবহারের মত ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে একাধারে শৈল্পিক বোধ, ঐতিহ্য, রংয়ের বিচিত্রতা এবং প্রতিনিয়ত শিল্পময় আবিষ্কারের ভাবনা নতুন নতুন সৌন্দর্যময় আবহ ও আক্ষরিকভাবেই নতুন দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছে। শিল্পের মহান গবেষকগণ, বিশেষ করে ইসলামিক আর্টের সাথে যারা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছেন। মুসলিম-অমুসলিম সব শিল্পবোদ্ধাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “মহান ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মিউজিক বা সঙ্গীতের মত। এটা আয়ত্ত করতে হয় তীক্ষ্ণ মনসংযোগ নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য সাধনা ও নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বিধি মেনে চলে।” প্রতিদিন গলা সাধার মত ক্যালিগ্রাফির কলম দিয়ে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হয়। হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফির গুপ্ত কৌশলগুলো শিখে নিতে হয়। ওস্তাদ যদি সূক্ষ্ম কৌশল দেখিয়ে না দেন তাহলে আক্ষরিক নিপুণতা বলতে যা বোঝায় সেটা আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য খাগের কলম কাটা এবং সেটা দিয়ে হরফকে স্বাচ্ছন্দ্যে লেখা সম্বন্ধে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক কাজী আহমদ যর্থাথ মন্তব্য করেছেন। তিনি কলমের প্রতীক এভাবে বর্ণনা করেছেন, “মানবের কাছে প্রভুর দেয়া সব জ্ঞানের বাহন হচ্ছে কলম।”

[লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে। দুই ভাগে দিলে ভাল হত। আগাম সরি জানাইলাম।]

আরবী ক্যালিগ্রাফি যেসব দেশে প্রধান শিল্পকলাররূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৫ শতক অথবা ১৬ শতক পর্যন্তও পেইন্টিংয়ে তা অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে পশ্চিমা শিল্পকলায়। কিন্তু ইসলামী ক্যালিগ্রাফির স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ প্লাস্টিক বা নমনীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, তরঙ্গমালার মত পুনরাবৃত্তি বা রিপিটেশন প্রয়োগ বিধি এটাই প্রমাণ করে যে, আরবী ক্যালিগ্রাফি তার এসথেটিক বা সৌন্দর্য দর্শন বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম। আর বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ের ইতালীয় পেইন্টিং বাইজেন্টাইন শিল্প কর্মগুলো এমনকি মধ্যযুগের ফরাসি গির্জা যেমন লা- পোতে আরবী নক্সাকলা, ক্যালিগ্রাফির জোরালো প্রভাব রয়েছে, কোথাও কোথাও হুবহু প্রয়োগও করা হয়েছে। এসব মটিফ বা সুন্দর নমুনাগুলো আরবী ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য দর্শনের চূড়ান্ত পর্যায় মেনে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করেন।

আরব সভ্যতার উত্থানের পেছনে যে উপাদানগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে প্রথমত-কুরআন, দ্বিতয়ত-ইসলাম পূর্ব কবিতা এবং চূড়ান্ত প্রর্যায়ে ক্যালিগ্রাফি ও স্থাপত্য। আরবী ক্যালিগ্রাফির গাঠনিক আকৃতি রূপদানকল্পে আরব ক্যালিগ্রাফারগণ জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন। এর সাথে আধ্যাত্ম অনুভব, ভাষার প্রতি একান্ত ভালবাসা ক্যালিগ্রাফির উৎকর্ষতা প্রদানে ভূমিকা রেখেছে। সারাবিশ্বে লিপিমালার শিল্পময় স্থান তুলনা করলে, অবধারিতভাবে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শীর্ষস্থান দখল করবে। ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা, সৌন্দর্যময়তা প্রদানের অত্যাগ্রহ ও পিপাসা, বিশ্বাসের প্রতি অঙ্গীকার, ধর্মীয়ভাবে তীক্ষ্ণ শিল্পবোধ সম্পন্ন ক্যালিগ্রাফারদের কঠোর সাধনা ও আত্মনিয়োগের ফলে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিশ্বখ্যাত মর্যাদায় আসীন হয়েছে।

পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে মূলত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির দ্রুত বিকাশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হাতে লিখে কুরআনের কপি করা হতো। ইসলামে সমাজ, ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুই কুরআন আবর্তিত। সুতরাং মুসলিম সভ্যতা কুরআনকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে। একে যতভাবে পারা যায় সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। একজন ক্যালিগ্রাফারের অধীনে বহু নক্সাকার ও কাতিব নিয়োজিত থাকতেন কুরআন কপি করার জন্য। ক্যালিগ্রাফার যাকে আরবিতে খাত্তাত বলা হয়, তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, যাতে প্রতিটি কুরআনের কপি যেন অনন্য সৌন্দর্যের আকর হয়। প্রতিটি হরফ, আয়াত, সূরার শিরোনাম, হাসিয়া বা পার্শ্বটিকা, বর্ডার অলংকরণ সবকিছুতেই ক্যালিগ্রাফার পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর দিতেন। দৃশ্যগত শিল্পে বিশেষ করে শিল্পকলায় শৈল্পিক ভিত্তি বা দর্শন গ্রহণের ক্ষেত্রে মেকি বা কৃত্রিম উপাদান-মটিফ, প্রিন্সিপল বা বিষয়গত সংযোজনা সৌন্দর্য দর্শনে প্রাকৃতিক উপাদানকে আবর্তিত করে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ফর্মের সবচেয়ে সার্থক ব্যবহার, প্রয়োগ ও কৌশলগত উপস্থাপনা মুসলিম ক্যালিগ্রাফারগণ স্বাচ্ছন্দ্যে করে থাকেন।

হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফি এসথেটিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছে। শিল্পময় উপস্থাপনাকে আপোসহীন মনোভাব নিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। কখনই ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে নান্দনিকতা ও হরফের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য সামান্যতম অবহেলা পাইনি। সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফারগণ কোন ছাড় দিতেন না। হরফের উপস্থাপনা যেন কাব্যিক অনুভব এনে দেয় তার জন্য রাতের পর রাত নির্ঘুম অনুশীলনী ও চর্চা অব্যাহত রাখতেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা। হরফের মসৃণতা, আকৃতি, সেপ ও সাইজ, গতি প্রকৃতি এবং স্টাইলের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়টি তাদের কাছে জীবন মৃত্যু পথের অনুভব এনে দিত। উদাহরণ স্বরূপ আলিফের মাথা বা রা’স ঠিকমত হচ্ছে কি-না তার জন্য দিস্তা দিস্তা কাগজ আর অসংখ্য দোয়াত খালি হয়ে যেত। কারণ, এই রা'সের ওপরেই পুরো হরফমালা আর স্টাইল নির্ভর করে।

নির্ভুল আর নিখুঁত হরফ লিখতে যে রকম অনুশীলন ও ধৈর্য দরকার, প্রতিবার যেন এই রকম হরফটি হয় সে চর্চাও চলত অবিরাম। প্রচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরবী ক্যালিগ্রাফিতে মাস্টার ক্যালিগ্রাফারগণ একাধারে কুরআন কপি ও অনুশীলনপত্র, যাকে আরবিতে “তাসউদ” এবং তুর্কী ভাষায় “কারালামা” বলে, তা তৈরী করবেন এবং সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফারদের মূল্যায়ন ও একত্রিত করার প্রয়ার চালাবেন। সমাজে তিনি ক্যালিগ্রাফিকে সাংস্কৃতিক আবহের মূল উপাদানে শামিলের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। এ সময়ের সমকালীন ইসলামী ক্যালিগ্রাফির যে স্কুল বা ধারাটি বিশ্বব্যাপী প্রবল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তা হচ্ছে বাগদাদের স্কুলটি। হাশিম মুহাম্মদ আল খাত্তাত আল বাগদাদী এবং ওসমানীয় শাসনামলের প্রাথমিক ওসমানীয় স্কুল যেটা শেখ হামাদুল্লাহ আল আমাসীর “নিও ক্লাসিক্যাল” যাকে কৌশল, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগিক দক্ষতাকে ৮ম শতাব্দী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় দাঁড় করিয়েছে।

সমকালীন ক্যালিগ্রাফিতে যে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে তা হচ্ছে, ট্রেডিশনাল ধারাকে আত্মস্থ করে আধুনিক শিল্পকলায় তা নতুনভাবে উপস্থাপন করা। বিশেষ করে পেইন্টিংয়ে নক্সাকলার সতর্ক ও সচেতন, বলা যায়, অতি সংবেদী উপস্থাপনা যেন ক্যালিগ্রাফিকে ছিটকে না ফেলে।

উল্লেখ্য, ট্রেডিশনাল ক্যলিগ্রাফিতে এ্যারাবেস্ক বা আল যুখরুফাহ আল আরাবিয়া অর্থাৎ আরবী নক্সাকলা প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সেক্ষেত্রে আধুনিক চিত্রকলার আরবী নক্সাকলার নির্বাচিত এবং সূক্ষè শিল্পবোধকে উদ্দীপ্ত করে এমন মোটিফ ক্যালিগ্রাফিতে ব্যবহার করা চলে। যেমনভাবে ইমেজকে ক্যালিগ্রাফি সাথে সমন্বয় করতে দেখা যায়। তবে ভিজ্যুয়াল ইমেজের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বর্তায়। যেখানে ইমেজ ক্যালিগ্রাফির ওজনকে খর্ব করে কিংবা ইমেজটা মূখ্য হয় সেখানেও পরোক্ষভাবে ক্যালিগ্রাফির পবিত্রতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে ডেকো আর্ট, যেখানে ক্যালিগ্রাফিতে মটিফ না এনে বর্ডারে, মাউন্টে নক্সা প্রয়োগ করা হয়। সেক্ষেত্রেও সৌন্দর্য দর্শনকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে বিখ্যাত মার্কিন ক্যালিগ্রাফার এম.জে. আল হাবিব মনে করেন।

ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি সাদা বা হালকা রং দিয়ে করা হয়। ফোরগ্রাউন্ড বা হরফ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাঢ় বিশেষ করে কালো রং দিয়ে করা হয়। নক্সা, মোটিভ কিংবা নুকতা বা ফোঁটাগুলো যাতে ছন্দ হারিয়ে না ফেলে সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়। আধুনিক পেইন্টিংয়ে পারস্পেকটিভ, স্পেস, রংয়ের ব্যাকরণ, সর্বোপরি শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ ও দর্শনকে উপস্থাপন করতে ট্্েরডিশনাল মোটিফের স্বাচ্ছন্দ্য অংশকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্যানভাসের পটভূমিতে মূখ্য বিষয়কে উপস্থাপনে কোন আয়াতাংশ, শব্দ, হরফকে প্রধান্য দিতে গিয়ে পুরো টেক্সকে ক্ষুদ্রাকৃতি করে প্রয়োগ করা হয়। কিংবা এমনভাবে টেক্সচারকে রংয়ের ভেতর প্রয়োগ করা হয় যাতে শৈল্পিক আবহ আরো জাঁকালো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হরফ ও পটভূমি মনোক্রমিক রংয়ের হয়ে থাকে, তবে ক্যালিগ্রাফিকে কৌশলে প্রাধান্য দেয়া হয়।

আধুনিক ক্যালিগ্রাফিতে ক্যালিগ্রাম বলে একটি ধারা চালু হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফারগণ এটা শুরু করলেও পশ্চিমা বিশ্বে এখন বেশ জনপ্রিয়। কালো কালির প্রক্ষেপনে বিভিন্ন ফিগার, বিশেষ করে পোট্রেটকে হরফ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বর্তমানে আরব আমিরাতে অবস্থানকারী ক্যালিগ্রাফি শিল্পী খলিলুল্লাহ ক্যালিগ্রামকে বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছেন। এটা মূলত তুগরা বা জুমরফিক ক্যালিগ্রাফিরই একটি শাখা।
স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারা বিশ্বব্যাপী নব নব আঙ্গিকে প্রয়োগ হচ্ছে। তুরস্কে ট্রেডিশনাল ধারার শীর্ষ কাজগুলো রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির বিচিত্র প্রয়োগ জোরেশোরে চালু হয়েছে। সৌদি আরবে বড় শহরগুলো সৌন্দর্যবর্ধনে ক্যালিগ্রাফিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কাজে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক ফর্ম ও কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য প্রধানত দু’ধরনের। এক. শৈলী ভিত্তিক বা ট্রেডিশনাল দুই. পেইন্টিং নির্ভর।

শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি এসে যায়। আক্ষরিক অর্থে শৈলী বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ দাবী করে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও শিল্প সমালোচকদের ওপর। শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন যেহেতু শিল্প সমালোচকরা করে থাকেন, এজন্য ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে সমালোচকদের দায় দায়িত্ব একটু বেশী রয়েছে বলে মনে করি। শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এদেশের প্রচলিত আরবী হরফ সম্পর্কে সাধারণের মাঝে যে ধারণা রয়েছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

এ দেশের জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশ আরবি হরফ বলতে কোলকাতা ছাপার কুরআনের হরফ বুঝে থাকেন। এই হরফ মূলত: নিশ্চল বা গতিহীন টাইপ সেট। এতে হাতের লেখার জীবন্ত প্রবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও খুব সীমিত পরিসরে লৌখনু ছাপার কুরআন রয়েছে, তবু তা অধিকাংশের কাছে পাঠ করা কঠিন বলে অনুযোগ রয়েছে। সুতরাং শৈলী বিষয়ক নন্দন তত্ত্বের আলোচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবী হরফের শৈলী বিষয়ক বিশুদ্ধতা যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেটা আরব দেশসমূহে বিশেষ করে তুরস্কে রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মগুলো যা গত তিন দশক ধরে শিল্পীগণ করেছেন। তার শৈলী ভিত্তিক বিবেচনা দেশীয় আঙ্গিকে যথেষ্ট আশাপ্রদ। এ কথা এজন্য বলা হচ্ছে, কারণ পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীর উৎকর্ষতা উন্নীত এবং আন্তরিক। নিবেদিত প্রাণ শিল্পীগণ একক ও দলগত প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন। বিদেশের ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাদের সরব অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত। ২০০৭ সালে তুরস্কের আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে ৫ জন শিল্পী, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা নুরুল্লাহ, মোরশেদুল আলম, মাসুম বিল্লাহ ও সিদ্দিকা আফরিন লামিয়া অংশগ্রহণ করেন। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের সদস্য। যেহেতু প্রতি বছর আয়োজিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে শৈলীগত সৌন্দর্যরূপের পরিবর্তন হচ্ছে তাই সাম্প্রতিক শিল্পকর্মের এবং ৩ দশক আগের শিল্পকর্মের শৈলীগত পার্থক্য বেশ বড় ধরনের। সাম্প্রতিক ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মগুলোতে শৈলীর উৎকর্ষতা চোখে পড়ার মত। হরফের গতি প্রকৃতি, বিভিন্ন ফন্টের নিপুন উপস্থাপন, কম্পোজিশনে নতুনত্ব, এমনকি সাম্প্রতিক মুয়াল্লা শৈলীর বেশ কয়েকটি মান সম্মত কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপ বা দর্শন কি? কয়েকটি বিষয় এর সাথে জড়িত, হরফের সঠিক সেপ ও সাইজ যেটা আল খাত আল মানসুব বা আনুপাতিক লেখনীর সাথে সম্পৃক্ত এবং ইবনে বাওয়াবের মানসুব আল ফায়েক অর্থাৎ সৌন্দর্যময় লেখনী আক্ষরিক অর্থে আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমীর কলম কাটার কলাকৌশল এতে পূর্ণতা এনেছে, কালির প্রস্তুতবিধি, ব্যবহার নীতিমালা, কাগজ বা উপায়-উপকরণ একটি নির্দিষ্ট বিধিমালার অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সুলুস লিপির আলিফটি ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লিখতে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। র’স বা মাথা হবে দেড় থেকে দুই ফোটা বা নোকতা বরাবর এবং জেসম বা শরীরটি ৫-৬ নোকতা বরাবর লম্বা হবে। শেষে মাথার নীচে কলমের ডান কোনা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এটা হল সাধারণ নিয়ম কিন্তু হরফের আকৃতি ও পরিমাপ ঠিক রাখার সাথে সাথে এর রৈখিক বাঁক ও ভাজগুলোও যথাযথ করতে হয়। এটি সরাসরি নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট যেটা হাতে-কলমে ওস্তাদ ছাত্রকে শিখিয়ে থাকেন। দর্শককেও এ বিষয়ে হাতে-কলমে আত্মস্থ করতে হয়। আর ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়ে আসছে ১৯৯৮ সাল থেকে। যেজন্য নবীন ক্যালিগ্রাফারদের বৃহৎ অংশটি শৈলীতে দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছে।

বাংলাদেশে শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি যারা চর্চা করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ এফ. বারী, বসির মেসবাহ, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা, নেসার জামিল প্রমুখ। আরিফুর রহমানের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে খাগের কলমের সরাসরি প্রয়োগ অনুপস্থিত। কিন্তু তিনি শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির প্রতি যত্নশীল। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে সুলস, নাসখ, দিওয়ানী, কুফী, রুকআ, নাস্তালিক, রায়হানী, মুহাক্কাক, ও মুয়াল্লা শৈলীর উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। রঙের মাধ্যম হিসেবে পানি রং, কালি, এ্যাক্রিলিক, তেল রং মেটাল রং প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাগজ, ক্যানভাস, কাঠ, পাথর, ধাতব মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি করা হয়ে থাকে।

চিত্রকলায় যেমন শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন রয়েছে তেমনি স্থাপত্যে বিশেষ করে মসজিদ গাত্রে আরবি ক্যালিগ্রাফি ইদানিং বাংলা ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক উপস্থাপন দেখা যায়। শিল্পী আরিফুর রহমান ২০০২ সালে কুমিল্লার গুনাই ঘর ও ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ বরিশালের গুঠিয়ায় ২টি মসজিদে বাংলা-আরবীতে শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেছেন। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পতেঙ্গায় সলগোলা জামে মসজিদ, ২০০৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার, সুন্ধিসার জামে মসজিদ, ২০০৫ সালে ঢাকা সেনানীবাসে সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদ, ২০০৪ সালে বারিধারা ডিওএইচএস মসজিদ, ২০০৬ সালে ঢাকা উত্তরার ৫নং সেক্টর জামে মসজিদ, ২০০৭ সালে হবিগঞ্জে শাহ সোলেমান ফতেহ গাজী (রহ:) দরগাহ-এ এবং ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পুরান ঢাকায় হোসেনী দালানে সুরা আর রাহমানের শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেন। ২০১১ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে শরীফপুর জামে মসজিদে টেরাকোটা ও রিলিফ পদ্ধতিতে সুরা আর রাহমান এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফি করেন। এসব স্থানে কুফি, সুলস, বেঙ্গল তুগরা, নাসখ, দিওয়ানী প্রভৃতি শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ এফ. বারীসহ কয়েকজন শিল্পী বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদ, ধর্মীয় ইমারতে ক্যালিগ্রাফি করেছেন।
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বৃহত্তম অংশ হচ্ছে পেইন্টিং নির্ভর। আর এই পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে প্রবীন ও খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের শিল্পকলার পেইন্টিংয়ে কিভাবে ক্যালিগ্রাফির সার্থক উপস্থাপন হতে পারে তা দেখিয়েছেন তিনি। তাকে বাংলাদেশের পেইটিং ক্যালিগ্রাফির পথিকৃত বলেছেন শিল্পবোদ্ধারা। প্রবীণ শিল্পী আবু তাহের, মরহুম শামসুল ইসলাম নিজামী, সবিহ-উল আলম, ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহিম মণ্ডল, আমিনুল ইসলাম আমিনসহ অর্ধ শতাধিক প্রবীণ নবীন শিল্পী আরবী-বাংলা হরফকে অনুসঙ্গ করে অসাধারণ সব ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করে চলেছেন। শিল্পী আবু তাহের অর্ধবিমূর্ত ঢংয়ে পেইন্টিং করে থাকেন। আরবী হরফের পরস্পর ছন্দ ও গীতিময়তা একটি টান টান আকুলতা নিয়ে ফুটে ওঠে তার শিল্পকর্মে। রং, ফর্ম ও রেখার আশ্চর্য সম্মিলন দেখা যায় তার ক্যালিগ্রাফিতে। শিল্পী সবিহ-উল আলমের ক্যালিগ্রাফিতে ত্রিমাত্রিক ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। শিল্পী ড. আব্দুস সাত্তারের ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচ্যকলার আবেশ মূর্ত হয়ে ওঠে। সাইফুল ইসলাম নিজস্ব স্টাইল ও রংয়ের সমন্বয়ে এক ভিন্ন জগত তৈরী করেছেন। তার ক্যালিগ্রাফিতে তাই নাগরিক ক্যালিগ্রাফির মূখরতা দেখা যায়। ইব্রাহীম মণ্ডলের ক্যালিগ্রাফিতে বাংলার নিসর্গ, ফর্ম ও রেখার সাথে রঙের উজ্জ্বল্য উপস্থিতি দশর্ককে আকর্ষণ করে। আমিনুল ইসলাম আমিন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বাস্তব জগতের সাথে আধ্যাত্মিক ক্যালিগ্রাফির সমন্বয় তুলে ধরেন তার শিল্পকর্মে। নিপুন তুলির ছোঁয়ায় তার শিল্প ভাস্বর হয়ে ওঠে।



এছাড়া আরো খ্যাতনামা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী রয়েছেন, যেমন- আমিরুল হক, মাহবুব মুর্শিদ, ফরেজ আলী, রেজাউল করীম, রাসা প্রমুখ তাদের ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ও ভাষ্কর্য চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি অঙ্গনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে হরফ যেহেতু অনুসঙ্গ হয়ে আসে, সেক্ষেত্রে শৈলীর উপস্থাপন হয় গণ্য। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে শৈলীও সমানভাবে পেইন্টিংয়ে উঠে আসে। তবে সেটা সংখ্যায় একেবারে হাতে গোনা। মূলত: পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে রং, ফর্ম, দর্শন চিন্তা, ব্যাকরণ প্রভৃতি লক্ষ্য রাখা হয়। পেইন্টিংয়ে শিল্পকর্ম হতে গেলে যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন শিল্পী সেদিকে গভীর দৃষ্টি রাখেন। ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে প্রায় সব শিল্পকর্মে এমন উপস্থাপন লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে পবিত্র কুরআন হাদিসের বাণী মূখ্য হয়ে আছে। এর সাথে শুধুমাত্র হরফের কম্পোজিশন যেমন আরিফুর রহমানের আলিফ বিন্যাস, ইব্রাহীম মণ্ডলের আলিফ নৃত্য শিল্পকর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাংলালিপি নির্ভর বহু উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান সহ অধিকাংশ শিল্পী তাদের শিল্প চর্চায় বাংলা ক্যালিগ্রাফিকে সযতেœ লালন করেছেন। এসব শিল্পকর্মে হরফের প্রান্তীয় স্ট্রোকগুলো প্রলম্বিত করে এবং কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে হরফকে ভেঙ্গেচুরে সমন্বয় ও ছন্দায়িত করার প্রয়াস চালানো হয়। অনেক শিল্পী তাদের কাজে বাংলা ক্যালিগ্রাফির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য না দিয়ে আরবী কুফি, সুলুস প্রভৃতির আদলে করতে চেয়েছেন, এতে অনেক শিল্পবোদ্ধা ভিন্ন মতামতও ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পেইন্টিংয়ে যে বাংলা ক্যালিগ্রাফি দেখছি সেটা ৯০ দশকের শেষ দিকেও তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প আক্ষরিক অর্থে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তিন দশক পর এই শিল্পের পথ চলায় প্রয়োজনীয় উপাদান উপকরণ যেমন সহজ লভ্য হয়েছে। তেমনি এর প্রতিষ্ঠায় একটি মজবুত ভিত্তিও পেয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে জানার জন্য বইপত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ সম্পর্কে ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের এখন দেখা মেলে। একটা কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিগত প্রয়াসকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিতে হয়। সেই সাথে যারা এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাদের অবদানও কম নয়। লেখালেখি, গবেষণার মাধ্যমে এ শিল্পের ইতিহাস সংরক্ষণ গতি প্রকৃতি মূল্যায়ন ও সবার কাছে এর পরিচয়, সৌন্দর্য, গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তুলে ধরার জন্য নিরলস সাধনা যারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অবদান যেন আমরা ভুলে না যাই। এদেশে ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন, প্রসার ও জনপ্রিয় করতে ইতোমধ্যে যে রচনা সম্ভার ও বইপত্র প্রকাশ পেয়েছে তা নিতান্ত কম নয়। শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদনের সাথে বাংলাভাষায় এর ইতিহাস ক্রমধারা, শৈল্পিক বিশ্লেষণ নিয়ে গ্রন্থও রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ওপর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিও নিচ্ছেন অনেকে।

ক্যালিগ্রাফির এই বিস্তৃতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেশ লক্ষণীয় প্রভাব পড়েছে। ৮০ দশকের গোড়ার দিকে ক্যালেন্ডারে সিনেমার নায়িকা ও নারীচিত্র প্রধান উপাদান ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ক্যালিগ্রাফি, মসজিদ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীই একচ্ছত্র স্থান দখল করে চলেছে। সরকারি বেসরকারি ইমারতে ইন্টেরিয়র সজ্জায় ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম বড় ধরনের স্থান করে নিয়েছে। এমন কি বিদেশে সরকারি উপহার সামগ্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম গুরুত্ব লাভ করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে বহু ইমারতে ক্যালিগ্রাফি মুরাল, ফ্রেস্কো প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফির যে বিস্তৃতি, তার মূল্যায়নে দেশের প্রথিতযশা কয়েকজন শিল্পীর মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি। শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, আমি একজন পেইন্টারের দৃষ্টি দিয়ে এটা বলতে পারি অক্ষর দিয়ে পেইন্টিং করার একটি প্রয়াস এখানে রয়েছে যাতে ক্যালিগ্রাফি ছাপিয়ে নান্দনিক রসের অনুভব আমরা পেতে পারি। শিল্পী আবু তাহের বলেন, বেশ কিছু শিল্পী গভীর মমত্ব ও আনুগত্য নিয়ে ক্যালিগ্রাফি চর্চায় মনযোগ দিয়েছেন এবং আনন্দের বিষয় এদের মধ্যে কেউ কেউ শিল্পবোদ্ধাদের মনে গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। শিল্পী সবিহ-উল আলম বলেন, ১৬২টি ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম নিয়ে ৬ষ্ঠ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ২০০৩ গুণে মানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটা নি:সন্দেহে যেমন আনন্দের তেমনই গৌরবের। স্পেন প্রবাসী বাংলাদেশী শিল্পী মনিরুল ইসলাম ক্যালিগ্রাফিকে মিস্ট্রিক্যাল ফর্ম উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য তিনি শিল্পীদেরকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। ১২তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রান্ড প্রাইজ প্রাপ্ত ইরানের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সিদাঘাত জাব্বারী বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এজন্য তিনি ক্যলিগ্রাফী প্রদর্শনীগুলোর আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীও বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির প্রশংসা করেছেন এবং উত্তরোত্তর উন্নয়ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

ক্যালিগ্রাফি চর্চা বাংলাদেশে এখনো সেইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করেনি। শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ কোর্স, ওয়ার্কশপ, ডেমন্সট্রেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত কিংবা আলাদা ফ্যাকাল্টিও হতে পারে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য একটি স্থায়ী গ্যালারী এখনো নেই। তবে এরও ব্যবস্থা হয়ে যাবে এমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ক্যালিগ্রাফি আর্কাইভ গড়ে উঠছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যে আয়োজন ও উপায়-উপকরণ ও ভিত্তির প্রয়োজন, তার বহুলাংশ ইতোমধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে।



১৪ জুলাই ২০১২ শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারীতে ৩২ শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকাকে ২০১২ সালের এশিয় অঞ্চলের রাজধানী উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীতে আইসেসকো'র ডিরেক্টর জেনারেল ড. আবদুল আজিজ ওসমান আলতুআইজরি শিল্পকর্ম আগ্রহ নিয়ে দেখেন এবং শিল্পমানে অতুলনীয় বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বলিষ্ঠ শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এগিয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল ও কুসুমাস্তীর্ণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার যেমন গুরু দায়িত্ব রয়েছে তেমনি রাজকীয় শিল্পকলা হিসেবে সরকারের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার দাবি রাখে। বিষয়টিকে বিবেচনার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানাই।

ছবি-নেট থেকে

ইসলামী ক্যালিগ্রাফি : প্রবাহমান এক শিল্পধারা



বিশ্বব্যাপী মুসলিম এবং ইসলামী সংস্কৃতি আজ এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন একটি প্রাচীন বৃক্ষ তার বহুদূর বিস্তৃত ফুলের ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে। ডালপালাগুলোতে বহুবর্ণের ফুলের মতো মুসলিম স্থপতি, শিল্পী, লেখক এবং চিন্তাবিদ-গবেষকগণ তাদের মহান ঐতিহাসিক ঐতিহ্যিক নিদর্শনকে নবরূপে, নতুন সাজে প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত করে চলেছেন। তাদের এই কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দীপনা ও প্রবাহকে আল হাল্লাজের রহস্যময় ও আধ্যাত্মিক কবিতার মত তুলনা করা যায়। অথবা প্রাচীন হিব্রু চিত্রকলার ঐতিহ্যিক রং ব্যবহারের মত ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে একাধারে শৈল্পিক বোধ, ঐতিহ্য, রংয়ের বিচিত্রতা এবং প্রতিনিয়ত শিল্পময় আবিষ্কারের ভাবনা নতুন নতুন সৌন্দর্যময় আবহ ও আক্ষরিকভাবেই নতুন দর্শনের প্রকাশ ঘটিয়েছে। শিল্পের মহান গবেষকগণ, বিশেষ করে ইসলামিক আর্টের সাথে যারা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছেন। মুসলিম-অমুসলিম সব শিল্পবোদ্ধাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে, “মহান ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মিউজিক বা সঙ্গীতের মত। এটা আয়ত্ত করতে হয় তীক্ষ্ণ মনসংযোগ নিয়ে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য সাধনা ও নিয়মতান্ত্রিক ও সুশৃঙ্খল বিধি মেনে চলে।” প্রতিদিন গলা সাধার মত ক্যালিগ্রাফির কলম দিয়ে অনুশীলনী চালিয়ে যেতে হয়। হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফির গুপ্ত কৌশলগুলো শিখে নিতে হয়। ওস্তাদ যদি সূক্ষ্ম কৌশল দেখিয়ে না দেন তাহলে আক্ষরিক নিপুণতা বলতে যা বোঝায় সেটা আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। এ জন্য খাগের কলম কাটা এবং সেটা দিয়ে হরফকে স্বাচ্ছন্দ্যে লেখা সম্বন্ধে বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি গবেষক কাজী আহমদ যর্থাথ মন্তব্য করেছেন। তিনি কলমের প্রতীক এভাবে বর্ণনা করেছেন, “মানবের কাছে প্রভুর দেয়া সব জ্ঞানের বাহন হচ্ছে কলম।”

[লেখাটা একটু বড় হয়ে গেছে। দুই ভাগে দিলে ভাল হত। আগাম সরি জানাইলাম।]

আরবী ক্যালিগ্রাফি যেসব দেশে প্রধান শিল্পকলাররূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ১৫ শতক অথবা ১৬ শতক পর্যন্তও পেইন্টিংয়ে তা অন্তর্ভূক্ত হতে পারেনি। বিশেষ করে পশ্চিমা শিল্পকলায়। কিন্তু ইসলামী ক্যালিগ্রাফির স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ প্লাস্টিক বা নমনীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, তরঙ্গমালার মত পুনরাবৃত্তি বা রিপিটেশন প্রয়োগ বিধি এটাই প্রমাণ করে যে, আরবী ক্যালিগ্রাফি তার এসথেটিক বা সৌন্দর্য দর্শন বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম। আর বাস্তব কথা হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ের ইতালীয় পেইন্টিং বাইজেন্টাইন শিল্প কর্মগুলো এমনকি মধ্যযুগের ফরাসি গির্জা যেমন লা- পোতে আরবী নক্সাকলা, ক্যালিগ্রাফির জোরালো প্রভাব রয়েছে, কোথাও কোথাও হুবহু প্রয়োগও করা হয়েছে। এসব মটিফ বা সুন্দর নমুনাগুলো আরবী ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য দর্শনের চূড়ান্ত পর্যায় মেনে নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করেন।

আরব সভ্যতার উত্থানের পেছনে যে উপাদানগুলো সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, তা হচ্ছে প্রথমত-কুরআন, দ্বিতয়ত-ইসলাম পূর্ব কবিতা এবং চূড়ান্ত প্রর্যায়ে ক্যালিগ্রাফি ও স্থাপত্য। আরবী ক্যালিগ্রাফির গাঠনিক আকৃতি রূপদানকল্পে আরব ক্যালিগ্রাফারগণ জ্যামিতিক ও প্রাকৃতিক উপাদানের প্রতি বিশেষ নজর দিয়েছেন। এর সাথে আধ্যাত্ম অনুভব, ভাষার প্রতি একান্ত ভালবাসা ক্যালিগ্রাফির উৎকর্ষতা প্রদানে ভূমিকা রেখেছে। সারাবিশ্বে লিপিমালার শিল্পময় স্থান তুলনা করলে, অবধারিতভাবে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি শীর্ষস্থান দখল করবে। ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা, সৌন্দর্যময়তা প্রদানের অত্যাগ্রহ ও পিপাসা, বিশ্বাসের প্রতি অঙ্গীকার, ধর্মীয়ভাবে তীক্ষ্ণ শিল্পবোধ সম্পন্ন ক্যালিগ্রাফারদের কঠোর সাধনা ও আত্মনিয়োগের ফলে ইসলামী ক্যালিগ্রাফি বিশ্বখ্যাত মর্যাদায় আসীন হয়েছে।

পবিত্র কুরআনকে কেন্দ্র করে মূলত ইসলামী ক্যালিগ্রাফির দ্রুত বিকাশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের পূর্বে হাতে লিখে কুরআনের কপি করা হতো। ইসলামে সমাজ, ব্যক্তি, পরিবার, রাষ্ট্র সব কিছুই কুরআন আবর্তিত। সুতরাং মুসলিম সভ্যতা কুরআনকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছে। একে যতভাবে পারা যায় সৌন্দর্যমণ্ডিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। একজন ক্যালিগ্রাফারের অধীনে বহু নক্সাকার ও কাতিব নিয়োজিত থাকতেন কুরআন কপি করার জন্য। ক্যালিগ্রাফার যাকে আরবিতে খাত্তাত বলা হয়, তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন, যাতে প্রতিটি কুরআনের কপি যেন অনন্য সৌন্দর্যের আকর হয়। প্রতিটি হরফ, আয়াত, সূরার শিরোনাম, হাসিয়া বা পার্শ্বটিকা, বর্ডার অলংকরণ সবকিছুতেই ক্যালিগ্রাফার পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর দিতেন। দৃশ্যগত শিল্পে বিশেষ করে শিল্পকলায় শৈল্পিক ভিত্তি বা দর্শন গ্রহণের ক্ষেত্রে মেকি বা কৃত্রিম উপাদান-মটিফ, প্রিন্সিপল বা বিষয়গত সংযোজনা সৌন্দর্য দর্শনে প্রাকৃতিক উপাদানকে আবর্তিত করে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ফর্মের সবচেয়ে সার্থক ব্যবহার, প্রয়োগ ও কৌশলগত উপস্থাপনা মুসলিম ক্যালিগ্রাফারগণ স্বাচ্ছন্দ্যে করে থাকেন।

হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ইসলামী ক্যালিগ্রাফি এসথেটিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছে। শিল্পময় উপস্থাপনাকে আপোসহীন মনোভাব নিয়ে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। কখনই ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে নান্দনিকতা ও হরফের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য সামান্যতম অবহেলা পাইনি। সৌন্দর্য রক্ষার ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফারগণ কোন ছাড় দিতেন না। হরফের উপস্থাপনা যেন কাব্যিক অনুভব এনে দেয় তার জন্য রাতের পর রাত নির্ঘুম অনুশীলনী ও চর্চা অব্যাহত রাখতেন ক্যালিগ্রাফি শিল্পীরা। হরফের মসৃণতা, আকৃতি, সেপ ও সাইজ, গতি প্রকৃতি এবং স্টাইলের বিশুদ্ধতা রক্ষার বিষয়টি তাদের কাছে জীবন মৃত্যু পথের অনুভব এনে দিত। উদাহরণ স্বরূপ আলিফের মাথা বা রা’স ঠিকমত হচ্ছে কি-না তার জন্য দিস্তা দিস্তা কাগজ আর অসংখ্য দোয়াত খালি হয়ে যেত। কারণ, এই রা'সের ওপরেই পুরো হরফমালা আর স্টাইল নির্ভর করে।

নির্ভুল আর নিখুঁত হরফ লিখতে যে রকম অনুশীলন ও ধৈর্য দরকার, প্রতিবার যেন এই রকম হরফটি হয় সে চর্চাও চলত অবিরাম। প্রচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরবী ক্যালিগ্রাফিতে মাস্টার ক্যালিগ্রাফারগণ একাধারে কুরআন কপি ও অনুশীলনপত্র, যাকে আরবিতে “তাসউদ” এবং তুর্কী ভাষায় “কারালামা” বলে, তা তৈরী করবেন এবং সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফারদের মূল্যায়ন ও একত্রিত করার প্রয়ার চালাবেন। সমাজে তিনি ক্যালিগ্রাফিকে সাংস্কৃতিক আবহের মূল উপাদানে শামিলের প্রাণান্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। এ সময়ের সমকালীন ইসলামী ক্যালিগ্রাফির যে স্কুল বা ধারাটি বিশ্বব্যাপী প্রবল প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তা হচ্ছে বাগদাদের স্কুলটি। হাশিম মুহাম্মদ আল খাত্তাত আল বাগদাদী এবং ওসমানীয় শাসনামলের প্রাথমিক ওসমানীয় স্কুল যেটা শেখ হামাদুল্লাহ আল আমাসীর “নিও ক্লাসিক্যাল” যাকে কৌশল, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োগিক দক্ষতাকে ৮ম শতাব্দী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় দাঁড় করিয়েছে।

সমকালীন ক্যালিগ্রাফিতে যে বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে তা হচ্ছে, ট্রেডিশনাল ধারাকে আত্মস্থ করে আধুনিক শিল্পকলায় তা নতুনভাবে উপস্থাপন করা। বিশেষ করে পেইন্টিংয়ে নক্সাকলার সতর্ক ও সচেতন, বলা যায়, অতি সংবেদী উপস্থাপনা যেন ক্যালিগ্রাফিকে ছিটকে না ফেলে।

উল্লেখ্য, ট্রেডিশনাল ক্যলিগ্রাফিতে এ্যারাবেস্ক বা আল যুখরুফাহ আল আরাবিয়া অর্থাৎ আরবী নক্সাকলা প্রায় অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। সেক্ষেত্রে আধুনিক চিত্রকলার আরবী নক্সাকলার নির্বাচিত এবং সূক্ষè শিল্পবোধকে উদ্দীপ্ত করে এমন মোটিফ ক্যালিগ্রাফিতে ব্যবহার করা চলে। যেমনভাবে ইমেজকে ক্যালিগ্রাফি সাথে সমন্বয় করতে দেখা যায়। তবে ভিজ্যুয়াল ইমেজের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা বর্তায়। যেখানে ইমেজ ক্যালিগ্রাফির ওজনকে খর্ব করে কিংবা ইমেজটা মূখ্য হয় সেখানেও পরোক্ষভাবে ক্যালিগ্রাফির পবিত্রতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে ডেকো আর্ট, যেখানে ক্যালিগ্রাফিতে মটিফ না এনে বর্ডারে, মাউন্টে নক্সা প্রয়োগ করা হয়। সেক্ষেত্রেও সৌন্দর্য দর্শনকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে বিখ্যাত মার্কিন ক্যালিগ্রাফার এম.জে. আল হাবিব মনে করেন।

ট্রেডিশনাল ক্যালিগ্রাফিতে ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি সাদা বা হালকা রং দিয়ে করা হয়। ফোরগ্রাউন্ড বা হরফ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গাঢ় বিশেষ করে কালো রং দিয়ে করা হয়। নক্সা, মোটিভ কিংবা নুকতা বা ফোঁটাগুলো যাতে ছন্দ হারিয়ে না ফেলে সেদিকে কড়া নজর রাখা হয়। আধুনিক পেইন্টিংয়ে পারস্পেকটিভ, স্পেস, রংয়ের ব্যাকরণ, সর্বোপরি শিল্পীর সৌন্দর্যবোধ ও দর্শনকে উপস্থাপন করতে ট্্েরডিশনাল মোটিফের স্বাচ্ছন্দ্য অংশকে বিবেচনা করা যেতে পারে। ক্যানভাসের পটভূমিতে মূখ্য বিষয়কে উপস্থাপনে কোন আয়াতাংশ, শব্দ, হরফকে প্রধান্য দিতে গিয়ে পুরো টেক্সকে ক্ষুদ্রাকৃতি করে প্রয়োগ করা হয়। কিংবা এমনভাবে টেক্সচারকে রংয়ের ভেতর প্রয়োগ করা হয় যাতে শৈল্পিক আবহ আরো জাঁকালো হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে হরফ ও পটভূমি মনোক্রমিক রংয়ের হয়ে থাকে, তবে ক্যালিগ্রাফিকে কৌশলে প্রাধান্য দেয়া হয়।

আধুনিক ক্যালিগ্রাফিতে ক্যালিগ্রাম বলে একটি ধারা চালু হয়েছে। আফ্রিকা অঞ্চলের ক্যালিগ্রাফারগণ এটা শুরু করলেও পশ্চিমা বিশ্বে এখন বেশ জনপ্রিয়। কালো কালির প্রক্ষেপনে বিভিন্ন ফিগার, বিশেষ করে পোট্রেটকে হরফ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত বর্তমানে আরব আমিরাতে অবস্থানকারী ক্যালিগ্রাফি শিল্পী খলিলুল্লাহ ক্যালিগ্রামকে বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছেন। এটা মূলত তুগরা বা জুমরফিক ক্যালিগ্রাফিরই একটি শাখা।
স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির ট্রেডিশনাল ধারা বিশ্বব্যাপী নব নব আঙ্গিকে প্রয়োগ হচ্ছে। তুরস্কে ট্রেডিশনাল ধারার শীর্ষ কাজগুলো রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে স্থাপত্যে ক্যালিগ্রাফির বিচিত্র প্রয়োগ জোরেশোরে চালু হয়েছে। সৌদি আরবে বড় শহরগুলো সৌন্দর্যবর্ধনে ক্যালিগ্রাফিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কাজে আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফারদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক ফর্ম ও কৌশলকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য প্রধানত দু’ধরনের। এক. শৈলী ভিত্তিক বা ট্রেডিশনাল দুই. পেইন্টিং নির্ভর।

শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টি এসে যায়। আক্ষরিক অর্থে শৈলী বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ দাবী করে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও শিল্প সমালোচকদের ওপর। শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন যেহেতু শিল্প সমালোচকরা করে থাকেন, এজন্য ক্যালিগ্রাফি বিষয়ে সমালোচকদের দায় দায়িত্ব একটু বেশী রয়েছে বলে মনে করি। শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির নন্দন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এদেশের প্রচলিত আরবী হরফ সম্পর্কে সাধারণের মাঝে যে ধারণা রয়েছে সেটা বিবেচনা করা প্রয়োজন।

এ দেশের জনগোষ্ঠির বৃহত্তম অংশ আরবি হরফ বলতে কোলকাতা ছাপার কুরআনের হরফ বুঝে থাকেন। এই হরফ মূলত: নিশ্চল বা গতিহীন টাইপ সেট। এতে হাতের লেখার জীবন্ত প্রবাহ খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও খুব সীমিত পরিসরে লৌখনু ছাপার কুরআন রয়েছে, তবু তা অধিকাংশের কাছে পাঠ করা কঠিন বলে অনুযোগ রয়েছে। সুতরাং শৈলী বিষয়ক নন্দন তত্ত্বের আলোচনায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরবী হরফের শৈলী বিষয়ক বিশুদ্ধতা যেটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সেটা আরব দেশসমূহে বিশেষ করে তুরস্কে রয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মগুলো যা গত তিন দশক ধরে শিল্পীগণ করেছেন। তার শৈলী ভিত্তিক বিবেচনা দেশীয় আঙ্গিকে যথেষ্ট আশাপ্রদ। এ কথা এজন্য বলা হচ্ছে, কারণ পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফিতে শৈলীর উৎকর্ষতা উন্নীত এবং আন্তরিক। নিবেদিত প্রাণ শিল্পীগণ একক ও দলগত প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন। বিদেশের ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাদের সরব অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত। ২০০৭ সালে তুরস্কের আন্তর্জাতিক ক্যালিগ্রাফি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে ৫ জন শিল্পী, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা নুরুল্লাহ, মোরশেদুল আলম, মাসুম বিল্লাহ ও সিদ্দিকা আফরিন লামিয়া অংশগ্রহণ করেন। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশের সদস্য। যেহেতু প্রতি বছর আয়োজিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে শৈলীগত সৌন্দর্যরূপের পরিবর্তন হচ্ছে তাই সাম্প্রতিক শিল্পকর্মের এবং ৩ দশক আগের শিল্পকর্মের শৈলীগত পার্থক্য বেশ বড় ধরনের। সাম্প্রতিক ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র আয়োজিত ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে শিল্পকর্মগুলোতে শৈলীর উৎকর্ষতা চোখে পড়ার মত। হরফের গতি প্রকৃতি, বিভিন্ন ফন্টের নিপুন উপস্থাপন, কম্পোজিশনে নতুনত্ব, এমনকি সাম্প্রতিক মুয়াল্লা শৈলীর বেশ কয়েকটি মান সম্মত কাজ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।

আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দন তাত্ত্বিক স্বরূপ বা দর্শন কি? কয়েকটি বিষয় এর সাথে জড়িত, হরফের সঠিক সেপ ও সাইজ যেটা আল খাত আল মানসুব বা আনুপাতিক লেখনীর সাথে সম্পৃক্ত এবং ইবনে বাওয়াবের মানসুব আল ফায়েক অর্থাৎ সৌন্দর্যময় লেখনী আক্ষরিক অর্থে আরবী ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া ইয়াকুত আল মুস্তাসিমীর কলম কাটার কলাকৌশল এতে পূর্ণতা এনেছে, কালির প্রস্তুতবিধি, ব্যবহার নীতিমালা, কাগজ বা উপায়-উপকরণ একটি নির্দিষ্ট বিধিমালার অন্তর্ভূক্ত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সুলুস লিপির আলিফটি ক্যালিগ্রাফি কলম দিয়ে লিখতে তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। র’স বা মাথা হবে দেড় থেকে দুই ফোটা বা নোকতা বরাবর এবং জেসম বা শরীরটি ৫-৬ নোকতা বরাবর লম্বা হবে। শেষে মাথার নীচে কলমের ডান কোনা দিয়ে পূরণ করতে হয়। এটা হল সাধারণ নিয়ম কিন্তু হরফের আকৃতি ও পরিমাপ ঠিক রাখার সাথে সাথে এর রৈখিক বাঁক ও ভাজগুলোও যথাযথ করতে হয়। এটি সরাসরি নন্দনতত্ত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট যেটা হাতে-কলমে ওস্তাদ ছাত্রকে শিখিয়ে থাকেন। দর্শককেও এ বিষয়ে হাতে-কলমে আত্মস্থ করতে হয়। আর ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ হাতে-কলমে ক্যালিগ্রাফি শিখিয়ে আসছে ১৯৯৮ সাল থেকে। যেজন্য নবীন ক্যালিগ্রাফারদের বৃহৎ অংশটি শৈলীতে দ্রুত উন্নতি করতে পেরেছে।

বাংলাদেশে শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি যারা চর্চা করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, শহীদুল্লাহ এফ. বারী, বসির মেসবাহ, মোহাম্মদ আবদুর রহীম, আবু দারদা, নেসার জামিল প্রমুখ। আরিফুর রহমানের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে খাগের কলমের সরাসরি প্রয়োগ অনুপস্থিত। কিন্তু তিনি শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির প্রতি যত্নশীল। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মে সুলস, নাসখ, দিওয়ানী, কুফী, রুকআ, নাস্তালিক, রায়হানী, মুহাক্কাক, ও মুয়াল্লা শৈলীর উপস্থাপন লক্ষ্য করা যায়। রঙের মাধ্যম হিসেবে পানি রং, কালি, এ্যাক্রিলিক, তেল রং মেটাল রং প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাগজ, ক্যানভাস, কাঠ, পাথর, ধাতব মাধ্যমে ক্যালিগ্রাফি করা হয়ে থাকে।

চিত্রকলায় যেমন শৈলীভিত্তিক ক্যালিগ্রাফির উপস্থাপন রয়েছে তেমনি স্থাপত্যে বিশেষ করে মসজিদ গাত্রে আরবি ক্যালিগ্রাফি ইদানিং বাংলা ক্যালিগ্রাফির শৈলী ভিত্তিক উপস্থাপন দেখা যায়। শিল্পী আরিফুর রহমান ২০০২ সালে কুমিল্লার গুনাই ঘর ও ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ বরিশালের গুঠিয়ায় ২টি মসজিদে বাংলা-আরবীতে শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেছেন। শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম ২০০০ সালে চট্টগ্রামে পতেঙ্গায় সলগোলা জামে মসজিদ, ২০০৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার, সুন্ধিসার জামে মসজিদ, ২০০৫ সালে ঢাকা সেনানীবাসে সেনা কেন্দ্রীয় মসজিদ, ২০০৪ সালে বারিধারা ডিওএইচএস মসজিদ, ২০০৬ সালে ঢাকা উত্তরার ৫নং সেক্টর জামে মসজিদ, ২০০৭ সালে হবিগঞ্জে শাহ সোলেমান ফতেহ গাজী (রহ:) দরগাহ-এ এবং ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে পুরান ঢাকায় হোসেনী দালানে সুরা আর রাহমানের শৈলী ভিত্তিক ক্যালিগ্রাফি করেন। ২০১১ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে শরীফপুর জামে মসজিদে টেরাকোটা ও রিলিফ পদ্ধতিতে সুরা আর রাহমান এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ক্যালিগ্রাফি করেন। এসব স্থানে কুফি, সুলস, বেঙ্গল তুগরা, নাসখ, দিওয়ানী প্রভৃতি শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। শিল্পী মনিরুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ এফ. বারীসহ কয়েকজন শিল্পী বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদ, ধর্মীয় ইমারতে ক্যালিগ্রাফি করেছেন।
বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বৃহত্তম অংশ হচ্ছে পেইন্টিং নির্ভর। আর এই পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে প্রবীন ও খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের শিল্পকলার পেইন্টিংয়ে কিভাবে ক্যালিগ্রাফির সার্থক উপস্থাপন হতে পারে তা দেখিয়েছেন তিনি। তাকে বাংলাদেশের পেইটিং ক্যালিগ্রাফির পথিকৃত বলেছেন শিল্পবোদ্ধারা। প্রবীণ শিল্পী আবু তাহের, মরহুম শামসুল ইসলাম নিজামী, সবিহ-উল আলম, ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহিম মণ্ডল, আমিনুল ইসলাম আমিনসহ অর্ধ শতাধিক প্রবীণ নবীন শিল্পী আরবী-বাংলা হরফকে অনুসঙ্গ করে অসাধারণ সব ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করে চলেছেন। শিল্পী আবু তাহের অর্ধবিমূর্ত ঢংয়ে পেইন্টিং করে থাকেন। আরবী হরফের পরস্পর ছন্দ ও গীতিময়তা একটি টান টান আকুলতা নিয়ে ফুটে ওঠে তার শিল্পকর্মে। রং, ফর্ম ও রেখার আশ্চর্য সম্মিলন দেখা যায় তার ক্যালিগ্রাফিতে। শিল্পী সবিহ-উল আলমের ক্যালিগ্রাফিতে ত্রিমাত্রিক ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে। শিল্পী ড. আব্দুস সাত্তারের ক্যালিগ্রাফিতে প্রাচ্যকলার আবেশ মূর্ত হয়ে ওঠে। সাইফুল ইসলাম নিজস্ব স্টাইল ও রংয়ের সমন্বয়ে এক ভিন্ন জগত তৈরী করেছেন। তার ক্যালিগ্রাফিতে তাই নাগরিক ক্যালিগ্রাফির মূখরতা দেখা যায়। ইব্রাহীম মণ্ডলের ক্যালিগ্রাফিতে বাংলার নিসর্গ, ফর্ম ও রেখার সাথে রঙের উজ্জ্বল্য উপস্থিতি দশর্ককে আকর্ষণ করে। আমিনুল ইসলাম আমিন চিকিৎসা বিজ্ঞান ও বাস্তব জগতের সাথে আধ্যাত্মিক ক্যালিগ্রাফির সমন্বয় তুলে ধরেন তার শিল্পকর্মে। নিপুন তুলির ছোঁয়ায় তার শিল্প ভাস্বর হয়ে ওঠে।



এছাড়া আরো খ্যাতনামা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী রয়েছেন, যেমন- আমিরুল হক, মাহবুব মুর্শিদ, ফরেজ আলী, রেজাউল করীম, রাসা প্রমুখ তাদের ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং ও ভাষ্কর্য চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি অঙ্গনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে হরফ যেহেতু অনুসঙ্গ হয়ে আসে, সেক্ষেত্রে শৈলীর উপস্থাপন হয় গণ্য। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে শৈলীও সমানভাবে পেইন্টিংয়ে উঠে আসে। তবে সেটা সংখ্যায় একেবারে হাতে গোনা। মূলত: পেইন্টিং ক্যালিগ্রাফিতে রং, ফর্ম, দর্শন চিন্তা, ব্যাকরণ প্রভৃতি লক্ষ্য রাখা হয়। পেইন্টিংয়ে শিল্পকর্ম হতে গেলে যেসব উপাদান থাকা প্রয়োজন শিল্পী সেদিকে গভীর দৃষ্টি রাখেন। ১০ম ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে প্রায় সব শিল্পকর্মে এমন উপস্থাপন লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে পবিত্র কুরআন হাদিসের বাণী মূখ্য হয়ে আছে। এর সাথে শুধুমাত্র হরফের কম্পোজিশন যেমন আরিফুর রহমানের আলিফ বিন্যাস, ইব্রাহীম মণ্ডলের আলিফ নৃত্য শিল্পকর্মের কথা উল্লেখ করতে হয়। বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি শিল্পে বাংলালিপি নির্ভর বহু উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে। ড. আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান সহ অধিকাংশ শিল্পী তাদের শিল্প চর্চায় বাংলা ক্যালিগ্রাফিকে সযতেœ লালন করেছেন। এসব শিল্পকর্মে হরফের প্রান্তীয় স্ট্রোকগুলো প্রলম্বিত করে এবং কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে হরফকে ভেঙ্গেচুরে সমন্বয় ও ছন্দায়িত করার প্রয়াস চালানো হয়। অনেক শিল্পী তাদের কাজে বাংলা ক্যালিগ্রাফির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য না দিয়ে আরবী কুফি, সুলুস প্রভৃতির আদলে করতে চেয়েছেন, এতে অনেক শিল্পবোদ্ধা ভিন্ন মতামতও ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে পেইন্টিংয়ে যে বাংলা ক্যালিগ্রাফি দেখছি সেটা ৯০ দশকের শেষ দিকেও তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প আক্ষরিক অর্থে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তিন দশক পর এই শিল্পের পথ চলায় প্রয়োজনীয় উপাদান উপকরণ যেমন সহজ লভ্য হয়েছে। তেমনি এর প্রতিষ্ঠায় একটি মজবুত ভিত্তিও পেয়েছে।

বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি সম্পর্কে জানার জন্য বইপত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিনের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ সম্পর্কে ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের এখন দেখা মেলে। একটা কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য শিল্পীদের ব্যক্তিগত প্রয়াসকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিতে হয়। সেই সাথে যারা এ শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাদের অবদানও কম নয়। লেখালেখি, গবেষণার মাধ্যমে এ শিল্পের ইতিহাস সংরক্ষণ গতি প্রকৃতি মূল্যায়ন ও সবার কাছে এর পরিচয়, সৌন্দর্য, গুরুত্ব, অপরিহার্যতা তুলে ধরার জন্য নিরলস সাধনা যারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অবদান যেন আমরা ভুলে না যাই। এদেশে ক্যালিগ্রাফির উন্নয়ন, প্রসার ও জনপ্রিয় করতে ইতোমধ্যে যে রচনা সম্ভার ও বইপত্র প্রকাশ পেয়েছে তা নিতান্ত কম নয়। শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, প্রতিবেদনের সাথে বাংলাভাষায় এর ইতিহাস ক্রমধারা, শৈল্পিক বিশ্লেষণ নিয়ে গ্রন্থও রচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ওপর সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিও নিচ্ছেন অনেকে।

ক্যালিগ্রাফির এই বিস্তৃতিতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেশ লক্ষণীয় প্রভাব পড়েছে। ৮০ দশকের গোড়ার দিকে ক্যালেন্ডারে সিনেমার নায়িকা ও নারীচিত্র প্রধান উপাদান ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ক্যালিগ্রাফি, মসজিদ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীই একচ্ছত্র স্থান দখল করে চলেছে। সরকারি বেসরকারি ইমারতে ইন্টেরিয়র সজ্জায় ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম বড় ধরনের স্থান করে নিয়েছে। এমন কি বিদেশে সরকারি উপহার সামগ্রী প্রেরণের ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম গুরুত্ব লাভ করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে বহু ইমারতে ক্যালিগ্রাফি মুরাল, ফ্রেস্কো প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করছে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ক্যালিগ্রাফির যে বিস্তৃতি, তার মূল্যায়নে দেশের প্রথিতযশা কয়েকজন শিল্পীর মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি। শিল্পী মুর্তজা বশীর বলেন, আমি একজন পেইন্টারের দৃষ্টি দিয়ে এটা বলতে পারি অক্ষর দিয়ে পেইন্টিং করার একটি প্রয়াস এখানে রয়েছে যাতে ক্যালিগ্রাফি ছাপিয়ে নান্দনিক রসের অনুভব আমরা পেতে পারি। শিল্পী আবু তাহের বলেন, বেশ কিছু শিল্পী গভীর মমত্ব ও আনুগত্য নিয়ে ক্যালিগ্রাফি চর্চায় মনযোগ দিয়েছেন এবং আনন্দের বিষয় এদের মধ্যে কেউ কেউ শিল্পবোদ্ধাদের মনে গভীর রেখাপাত করতে সক্ষম হয়েছেন। শিল্পী সবিহ-উল আলম বলেন, ১৬২টি ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম নিয়ে ৬ষ্ঠ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী ২০০৩ গুণে মানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটা নি:সন্দেহে যেমন আনন্দের তেমনই গৌরবের। স্পেন প্রবাসী বাংলাদেশী শিল্পী মনিরুল ইসলাম ক্যালিগ্রাফিকে মিস্ট্রিক্যাল ফর্ম উল্লেখ করে বলেন বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য তিনি শিল্পীদেরকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। ১২তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে গ্রান্ড প্রাইজ প্রাপ্ত ইরানের বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী সিদাঘাত জাব্বারী বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফি চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করেন। এজন্য তিনি ক্যলিগ্রাফী প্রদর্শনীগুলোর আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীও বাংলাদেশের ক্যালিগ্রাফির প্রশংসা করেছেন এবং উত্তরোত্তর উন্নয়ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

ক্যালিগ্রাফি চর্চা বাংলাদেশে এখনো সেইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করেনি। শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ কোর্স, ওয়ার্কশপ, ডেমন্সট্রেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তবে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত কিংবা আলাদা ফ্যাকাল্টিও হতে পারে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য একটি স্থায়ী গ্যালারী এখনো নেই। তবে এরও ব্যবস্থা হয়ে যাবে এমন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে ক্যালিগ্রাফি আর্কাইভ গড়ে উঠছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যে আয়োজন ও উপায়-উপকরণ ও ভিত্তির প্রয়োজন, তার বহুলাংশ ইতোমধ্যে জোগাড় হয়ে গেছে।



১৪ জুলাই ২০১২ শিল্পকলা একাডেমী গ্যালারীতে ৩২ শিল্পীর ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। ঢাকাকে ২০১২ সালের এশিয় অঞ্চলের রাজধানী উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীতে আইসেসকো'র ডিরেক্টর জেনারেল ড. আবদুল আজিজ ওসমান আলতুআইজরি শিল্পকর্ম আগ্রহ নিয়ে দেখেন এবং শিল্পমানে অতুলনীয় বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্প সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বলিষ্ঠ শিল্প মাধ্যম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং এগিয়ে চলেছে। এর ভবিষ্যত উজ্জ্বল ও কুসুমাস্তীর্ণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার যেমন গুরু দায়িত্ব রয়েছে তেমনি রাজকীয় শিল্পকলা হিসেবে সরকারের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতার দাবি রাখে। বিষয়টিকে বিবেচনার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানাই।

ছবি-নেট থেকে

সোমবার, ২৫ জুন, ২০১২

শিল্পকর্ম তৈরির একটা গোপন কৌশল




ছবি আঁকার আগে শিল্পী হৃদয়ে একটা চিত্র এঁকে ফেলেন। প্রায়সই দেখা যায় ক্যানভাসে আঁকা শেষে অন্য একটা কিছু দাড়িয়ে গেছে। কখনও কখনও শিল্পী নিজেই তা দেখে চমকে ওঠেন।

(আমি সেরকম কোন শিল্পী না হলেও লেখার ভেতর এমন কিছু হতে পারে তা টের পাইলাম আজ। কি লিখতে বসে এটা কি লিখলাম।)

আমি চিন্তা করছিলাম মিনিয়েচার নিয়ে কিছু লিখব। কিন্তু একটা ছবি দেখে মনে হল, শিল্পী কেন এভাবে আঁকেন? নেটে গুতোগুতি করে যা পাইলাম তা এরকম।

সৌন্দর্য ব্যাপারটার সাথে ভাল লাগা জড়িত। প্রশ্ন হল একটা শিল্পকর্ম কেন ভাল লাগে?

এই ভাল লাগার জন্য শিল্পী তার কাজে কিছু কৌশল অবলম্বন করেন। অনেক কৌশলের ভেতর একটা গোপন টেকনিক হচ্ছে গোল্ডেন রেসিওর ব্যবহার। গোল্ডেন রেসিও সম্পর্কে আমরা কম-বেশি সবাই জানি। প্রকৃতিতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।

তবে আর্টে এই রেসিওর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। শিল্পী এমনভাবে আঁকেন যেন তার শিল্পকর্ম দর্শককে বলে, আমি তোমাকে দেখাতে চাইনা কিন্তু তুমি আমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখো।

এই যে লুকোচুরি খেলা, এটা সার্থকভাবে শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তোলার জন্য শিল্পী গোল্ডেন রেসিওর ব্যবহার করে থাকেন।



যারা ডানহাতি আর্টিস্ট তাদের ছবিতে ডান পাশে মূল কেন্দ্রবিন্দু চলে আসে হৃদয় থেকে। তবে শিল্পী ইচ্ছাকৃত এই মূল বিন্দুকে বিভিন্ন স্থানে বসিয়ে নিরীক্ষা করে থাকেন।



প্রকৃতিতে এই ফিবনাক্কি মজাটা অনেক রয়েছে। এতে সৌন্দর্য্যের মনিমুক্তা আমাদেরকে মোহিত করে।



মোনালিসা আঁকতে গিয়ে ভিঞ্চি এই সূত্র প্রয়োগ করেছিলেন বলে কোথাও উল্লেখ দেখা যায় না।

কিন্তু এখানে কেউ সেটা বসিয়ে ভাব নিয়েছে, দেখো.. মোনালিসা এত সুন্দর লাগার পেছনে এই হচ্ছে রহস্য।

হাহাহা...আসলে এটা মজা হলেও ছবিটাতে মূল বিন্দু থেকে ছড়িয়ে পড়ার ভেতর যে পারস্পরিক সম্পর্ক থাকে, যেমন টেনশন বা প্লাস্টিসিটি যাই বলিনা কেন, তা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাডেমিক শিক্ষায় আমরা যা শিখি, পরবর্তি মুক্ত জীবনে এসে শিল্পের সেই উপকরনগুলো মনের অজান্তেই প্রয়োগ হতে থাকে।

মডার্ণ আর্টিস্টদেরকে এই গোল্ডেন রেসিও প্রভাবিত করে বিভিন্নভাবে। জোসেফ স্তেলা(J o s e p h S t e l l a
) সাম্প্রতিক এরকম কিছু কাজ করেছেন। একে তিনি ফিবোনাক্কি সিরিজও বলেছেন।



বাংলাদেশে আর্টিস্টরা এরকম কাজ করেছেন। চারুকলায় গেলে তা দেখা যায়। এটা একটা কমন বিষয়। তেমনি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়েও এটা দেখা যায়। আজ এরকম একটি কাজ আমার নজরে পড়ল। ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ আবদুর রহীমের 'ঐক্য' নামে একটি ক্যালিগ্রফি পেইন্টিং দেখেন।



এক্রিলিকে করা এ পেইন্টিংটাতে একটি ঘরের আকৃতিতে 'আল্লাহ' লেখা। ক্যালিগ্রাফার হয়ত বুঝাতে চেয়েছেন ঐক্যের মূল বিন্দু বা ফোকাস আল্লাহ হতে পারেন। আবার এটা কাবা ঘরের মত মনে হতে পারে, কাবা মুসলমানদের ঐক্যের প্রতিক। যাইহোক, আসলে এটাতে মূলবিন্দুকে উপস্থাপণের ব্যাপারে ফিবোনাক্কি বা গোল্ডেন রেসিও থিউরির একটা প্রভাব দেখা যায়।



তার আরেকটা ক্যালিগ্রাফি 'সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আলা' সুলুস শৈলিতে করা। এখানে ক্যালিগ্রাফি পড়ার শুরুটা দেখানো আছে। আসলে ওটাই হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির মূল ফোকাস বিন্দু। মজার বিষয় হচ্ছে, এতেও গোল্ডেন রেসিওর প্রভাব রয়েছে বলে মনে হয়।

আজ এই পর্যন্ত।

ছবি- নেট থেকে।