শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বাঙালা বনাম বাংলা

বাংলা লিপি নিয়ে নতুন করে পড়তে গিয়ে অনেক নতুন বিষয়ে নজর আটকে যাচ্ছে। পড়ার জন্য পড়া আর লেখার জন্য পড়াতে যে ফারাক আছে, এখন তা বেশ ভালই টের পাচ্ছি। বাংলা লিপির ঠিকুজি খুজতে গিয়ে কতগুলো শব্দ পেলাম। বাঙালা, বাঙ্লা, বাঙ্গালা(বাঙ+গালা), বাংলা। অনুরূপ বাঙালী, বাঙ্গালী, বাঙ্লাদেশ, বাঙালা দেশ, বাংলা দেশ, বাংলাদেশ শব্দ দেখতে পেলাম।

এখন আমার হাতে যে বইটি আছে, সেটার প্রথম পৃষ্ঠার কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি,

"বাঙালী'র বাঙালা। এক 'বাঙালী' নয়। দুই 'বাঙালী'। এক 'বাঙালা নয়। দুই 'বাঙালা'। কেবল দুই দেশ নয়। দুই জাতি; দুই ভাষাও। অথচ আমরা অনেকেই জানিনে, অতি পুরানো আমলে, সেই দেশ-দু'টোর একটার নাম ছিল-'বঙ্গাল', 'বঙাল' বা 'বাঙালা'; অপরটার নাম ছিল 'বঙ্গ'। পরে এই 'বঙ্গ' হয় 'গৌড়'। তারও পরে, সেই 'বঙাল' আর 'গৌড়' মিলে হয় 'বাঙালা' বা 'বাঙ্গালাহ্'। সময়টা তখন ইংরেজী ১৩৫১। তার পরও 'বাঙালা' ও 'বাঙালী'র ভাঙা-গড়া হ'য়েছে। তা হ'য়েছে ১৯০৫-এ একবার। ১৯১১-য় একবার। ১৯৪৭-এ এক বার। ১৯৭১-এ আর এক বার। ফলে, দেশের নাম বদলের সাথে সাথে জাতিরও নাম ব'দলেছে বার বার। আর, এভাবেই বাঙালা দেশ, বাঙালা ভাষা, ও বাঙালী জাতির বিকাশ ঘ'টেছে নানা রকম।

তাই আজকের "বাঙ্লাদেশ" আর আগের 'বাঙালা দেশ' এক নয়। আজকের বাঙালী জাতি ও আগেকার বাঙালী জাতির হকিকৎও এক নয়।"

--------------বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস, পৃ-১


১৭০০-১৭৯২ সালের বৃহত্তর বাঙালার ম্যাপ


একই ম্যাপ নিচেরটায় লাল দাগে বাউন্ডারি দেখানো হয়েছে।




"বাংলা" বানানের বিষয়ে কিছু লেখা পেলাম।

ক.
"..অনুস্বারের ধ্বনি বাঙ্গালা ভাষায় "ঙ"-এর উচ্চারণের সহিত অভিন্ন হইয়া দাঁড়ানোর ফলে, "বাঙ্লা" শব্দকে "বাংলা" রূপে লেখা হয়। কিন্তু "বাঙাল-বাঙালী" এই শব্দ-দ্বয়ে অনুস্বার লেখা অসম্ভব।... এতদ্ভিন্ন, সংস্কৃতে অনুস্বারের যে উচ্চারণ ছিল... তাহার বিচার করিলে অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" শব্দের সংস্কৃত মতে উচ্চারণ দাঁড়ায় "বাআঁলা"; উত্তর-ভারতে এখন অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" উচ্চারিত হইবে "বান্ লা" রূপে, দক্ষিণ-ভারতে "বাম্ লা" রূপে। এই সমস্ত কারণে, "ঙ"-দিয়া "বাঙ্লা" লেখাই যুক্তিযুক্ত।"

----------ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়


খ.
"কিন্তু ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যেহেতু এই শব্দের বিশুদ্ধরূপ প্রায় সবখানেই "বাঙ্গালা" লিখেছেন, সেজন্য আমি এ-গ্রন্থের(বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস) সর্বত্রই "বাংলা", "বাঙ্লা" "বাঙলা" বা "বাংগলা"(ঙ-এর নিচেয় হস্ চিহ্ন না দিলে, তার উচ্চারণ 'বাংগোলা' দাঁড়ায়, আর হস্-চিহ্ন দিলে; তার উচ্চারণ "বাংলা"-র মত) না-লিখে, আধুনিক কালের শুদ্ধ রূপ 'বাঙালা' শব্দরূপ ব্যবহার করেছি। বর্তমান "বাংলাদেশ" বোঝাতে লিখেছি-"বাঙ্লাদেশ"।"

-----------অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান
সাবেক চেয়ারম্যান, বাঙালা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


গ.
ড. হুমায়ুন আজাদ তার লেখা বই-পত্রে সবখানেই "বাংলা" শব্দের অনুস্বারকে "ঙ" দিয়ে 'বাঙলা' লিখেছেন।



ঘ.
আহমদ শরীফ তার বইতে 'বাঙলা' শব্দ "ঙ" দিয়ে লিখেছেন।



ঙ.
ব্লগার 'শনিবারের চিঠি' তার সে-ই আটটি শাশ্বত ডাকটিকেট পোস্টে ডাকটিকেট গুলোর ছবি দিয়েছেন।





এখানে মজার একটি বিষয় আছে, 'বাংলাদেশ' শব্দকে 'বাংলা দেশ' এবং ইংরেজিতেও Bangla Desh লেখা হয়েছে।

আর পোস্টের ভেতর "বাঙলাদেশ" শব্দ "ঙ" দিয়ে লেখা হয়েছে।



প্রথম ছাপানো ১টাকা নোটেও এই ব্যাপার আছে।



এছাড়া দৈনিক আজাদী পত্রিকার ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যা মূল হেডিং-এ "জয় বাংলা, বাংলার জয়" লেখা এবং সেটার নিচেই লেখা আছে-"জয় বাঙলা, বাঙলার জয়"



এবিষয়ে পুরাতন ডকুমেন্টগুলো 'বাঙলা' শব্দ দেখাচ্ছে।
এখন জানার বিষয় বিষয় হচ্ছে, কখন থেকে "বাঙলা" শব্দ "বাংলা" শব্দে রুপান্তরিত হল এবং কেন সেটা করা হল?

যেহেতু বাংলা শব্দ দিয়ে বাঙালি বা বাঙ্গালী শব্দ লেখা যায় না। ং-কে ঙ করার কোন বিধান ব্যাকরণে নেই। তাহলে এই প্যাচ বা ত্যানা কিভাবে আমরা পেলাম।

আসেন ভাইয়েরা আলোচনা করি।

ছবি- নেট থেকে মারিং।

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১

লিপি নিয়ে কিছু কথা (এক)

লিপির প্রয়োজন কেন?
একটা চিরন্তন সত্য হচ্ছে, মানুষের জীবনটা আয়ুর পরিধিতে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার কীর্তি সময়কে অতিক্রম করে অমরত্ব লাভে সক্ষম। আর এ জন্যই সচেতন মানুষ মাত্রই স্বীয় অমর কীর্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকেন। আমরা অতীত এবং বর্তমান সময়ের পরতে পরতে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই, রাজা রাজন্যসহ সমাজপতি সচেতন শিক্ষিত শ্রেণী তাদের কীর্তিকথা বিজয়গাথা, রাজ্যশাসনের নীতিমালা, উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রভৃতি লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
কালের অতল গহ্বরে অনেক কীর্তি হারিয়ে যায় আবার কোন উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় অতীত রহস্য।
ভবিষ্যতের জন্য কীর্তির তথ্য জমা রাখার সহজ পন্থা হিসেবে লিপির অবলম্বন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
এভাবে লিপির মাধ্যমে অতীত অভিজ্ঞতা চলে আসে বর্তমানের হাতে।


হরফতত্ত্ব(Paleography)
প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার এবং সেসব লিপির আগাপাশতলা বের করার জন্য এক ধরণের জ্ঞান চর্চা করা হয়, এটা হরফতত্ত্ব নামে পরিচিত। প্রত্নতত্ত্বে যে মটিফ(Motif) সংরক্ষণ করা হয়, তাতে টেরাকোটা 'তবক' বা চাকতি লিপি(terracotta tablet script), ধাতব ফলকলিপি(metal plates inscriptions), বা শিলা ফলকলিপি(stone inscriptions) প্রধান। এছাড়া আরো নানান রকম উপাদান আছে, যা হরফতত্ত্বের অন্তর্ভূক্ত।
এ এক বিচিত্র এবং অত্যন্ত কষ্টসাধ্য জ্ঞান চর্চা। এমনও ঘটনা আছে একটি শিলালিপির পাঠোদ্ধার(decipher) করতে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। যদিও একটা পাঠ পাওয়া গেল, কিন্তু পরে তা ভুল প্রমাণিত হলো। তবু প্রথম পাঠকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়।


লিপি নিয়ে যারা কাজ করেন
লিপি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের কাজের ধরণ ভিন্ন ভিন্ন দেখা যায়। কেউ লিপির প্রাচীন পাঠোদ্ধারে জীবন কাটিয়ে দেন। কেউ নতুন লিপি তৈরির কাজ করেন, যাকে লিপিকার(Calligrapher/Calligraphist) বলা হয়। আবার লিপি নিয়ে শিল্পকলা করেন যিনি, তাকে লিপিশিল্পী(Calligraphy Artist) বলে।
প্রত্নতত্ত্বের সাথে শিলালিপির পাঠোদ্ধার(decipher) বিষয়টি জড়িত। ছাপাখানা, বই হাতে লেখা, প্রচ্ছদ, বই অলঙ্করণ প্রভৃতির সাথে নতুন লিপি বা প্রচলিত লিপির নতুন সংস্করণ করেন লিপিকার।
আর শিল্পকলায় লিপিকে অনুসঙ্গ করে কিংবা লিপি দিয়েই শিল্পকর্ম করেন লিপিশিল্পীরা। আমাদের ঢাকার চারুকলায় প্রাচ্যকলা বিভাগে এ বিষয়ে তালিম দেয়া হয়।
তবে অধিকাংশ ভাষার লিপি দিয়ে এখন আর শিল্পকলার প্রবাহমান ধারা লক্ষ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে চীনা ও জাপান বা কোরীয় লিপি চিত্রের অনুসঙ্গ হিসেবে এখনও টিকে আছে। আর আরবি লিপি নিজেই একটি জীবন্ত শিল্পকলা হিসেবে ঐতিহ্যবাহী ধারা এবং আধুনিক শিল্পকলা হিসেবে প্রবহমান।

লিপির ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেক ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। সেদিক দিয়ে আমরা গর্বিত, আমাদের বাংলা ভাষার নিজস্ব লিপি আছে।



চিত্র-এক.
প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি(হায়েরেগ্লিফিক)। এ ধরণের লিপি ধর্মীয় এবং শাসকদের বর্ণনা সংরক্ষণের জন্য বেশি ব্যবহার করা হত। একে পবিত্র লিপিও বলা হয়।


চিত্র-দুই.
প্রাচীন কিলকাকার(কিউনিফর্ম) লিপি, উৎকীর্ণ প্যালেট।


চিত্র-তিন.
লাতিন লিপি উৎকীর্ণ করা হচ্ছে। হাতে আকা প্রাচীন ছবি


চিত্র-চার.
আব্রাহাম(ইব্রাহিম) এবং তার পুত্রের কুরবানির ঘটনা উল্লেখ করে চিত্র সম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থ।


চিত্র-পাঁচ.
ধর্মীয় গ্রন্থ লিখছেন একজন ক্যালিগ্রাফার। একটি কল্পিত চিত্র আকা হয়েছে।


চিত্র-ছয়.
মধ্যযুগে হাতে আকা একটি ছবিতে একজন লিপিকার লেখার কাজ করছেন।


চিত্র-সাত.
মধ্যযুগে এটি গ্রন্থের অলংকৃত লিপিসহ একটি পাতা।


কারো কাছে এ বিষয়ে কোন তথ্য থাকলে দয়া করে জানাবেন।

লেখার তথ্য সূত্র-
১. বর্ণমালার উদ্ভববিকাশ ও লিপিসভ্যতার ইতিবৃত্ত
২. ভাষা লিপি ও সাহিত্য
৩. বাঙালা লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস
৪. বই এল কেমন করে

লিপির আবিস্কারের কথা

লিপির আবিস্কারের কথা নিয়ে কথা

লিপির আবিস্কার কিভাবে হল, এ নিয়ে ইউরোপীয় বিখ্যাত লিপিতত্ত্ববিদ কানিংহাম বলেন- মানুষ তার চারপাশের দৃশ্যমান বস্তু দর্শন করে সেই সব বস্তুর অনুরূপ আকারে অক্ষর তৈরি করেছে।

এছাড়া অন্যমত হচ্ছে- পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থগুলো হচ্ছে ধর্মের। তাই লিপির আবিস্কার ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ প্রায় অধিকাংশ ভাষা লিপির বর্ণগুলো দেব-দেবী বা অলৌকিক কিছুর নামে নামকরণ করা হয়েছে।


কিউনিফরম বা কিলকাকার লিপি

মিশরীয় চিত্রলিপির ছক
প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি
চিত্রলিপি
সূত্র-১.বাঙালা-লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস।

বাংলা লিপি এবং লিপিকলার ইতিহাস



বাংলা লিপি এবং লিপিকলার ইতিহাস
সংস্কৃত ভাষায় দেবনাগরি অক্ষরে লিখিত গৌতম বুদ্ধের জীবন কথা ভিত্তিক 'জাতক' গ্রন্থে বুদ্ধ দেবের শৈশবে শিক্ষা লাভের কাহিনী বর্ণনা কনতে গিয়ে ৬৪টি লিপির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে "বঙ্গের লিপি" কথাটি আছে।
এছাড়া দেওয়ান গোলাম মোর্তজা, জৈন লেখকদের 'সমথায়ঙ্গ' ও ভগবতী সুত্ত' গ্রন্থে বঙ্গলিপির কথা আছে বলে জানিয়েছেন।

প্রাচীনকালে বাংলা গ্রন্থ লেখার জন্য হস্তলিপিকারগণ প্রয়াস চালাতেন যাতে লেখাটা যেন আকর্ষণীয় হয়। হরফ দিয়ে শিল্পকলা করার কথা জানা যায় না।
বাংলা লিপিকলা সাম্প্রতিক সময়ে চালু হয়েছে।

বাংলা ভাষা লিখতে বিভিন্ন লিপির ব্যবহার
এ অঞ্চলে মুসলিম ও ইংরেজ আমলে আরবি, ফারসি বা উর্দু হরফে বাংলা লেখা ছাড়াও সিলেটি, নাগরি, কায়েথি, উড়িয়া, নেওয়ারি, রোমান ও আসামি লিপিতে বাংলা গ্রন্থ রচনার নজির রয়েছে।

মুসলিম আমলে মুসলিম এবং হিন্দু লেখক নির্বিশেষে আরবি-ফার্সি হরফে বাংলা পুঁথি লিখেছেন। এ রকম অনেক পুঁথি ঢাবি লাইব্রেরিতে আছে।

আর ৬০দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামে জুলফিকার আলি আরবি-ফার্সি(উর্দু) লিপিতে একটি পত্রিকা বের করতেন। এর কপি আমার কাছে এখন নেই। তবে খুঁজে দেখা যেতে পারে।


আমার কাছে যে নমুনাটি আছে, এটি ঢা.বি'র পুথিশালায় রক্ষিত আরবি হরফে লেখা বাংলা "জেবল মুলুক সামারোখ" পুথির একটি পাতার ছবি।

ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় তার OBDL-এর প্রথম খণ্ডে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার কথা উল্লেখ করেছেন,
তিনি 'যোগি কলন্দর'র কিছু নমুনা তুলে ধরে বিশ্লেষণ করেছেন।

সূত্র- বাঙালা-লিপির উৎস ও বিকাশের অজানা ইতিহাস


কেউ ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলতে চাইলে আমার মেইলে বলতে পারেন- shekherpo@gmail.com

স্মৃতিকথা-1

 

 

আমার বোর্ডিং বেলার কথা

এক.
হাইস্কুলের বোর্ডিংয়ে একটা সময় আমার কেটেছে। বোর্ডিংয়ে এসে কয়েকদিনের মধ্যে জমিয়ে ফেললাম। খেলাধুলা, গান-কবিতা, ছবি আকা এবং দেয়াল পত্রিকা বের করা ইত্যাদিতে ভালই সময় কাটতে লাগল। সিনিয়র ভাইরা দেয়াল পত্রিকা বের করবে। আমি তাদের সাথে অংশ নিতে চাইলাম।

আমাকে চান্স দিল না। বলা হল, লেখাটেখা দিতে পারো, সিলেক্ট হলে পত্রিকায় ঠাই পাবে। খোজ নিয়ে জানলাম, আমাদের জুনিয়ররা বেইল পাবে না। তো কি আর করা। আমরা গোপনে আলাদা ভাবে একটা দেয়াল পত্রিকা করে ফেললাম, নাম দেয়া হল- নবীন উষা। যেদিন বড়দের দেয়ালিকা বোর্ডে টানানো হল। সেদিন আমাদের নবীন উষাও আমার রুমের সামনে দেয়ালে টানানো হল। বোর্ডিং সুপার বড়দের দেয়ালিকার স্পন্সর। তিনি খবর পেয়ে পত্রিকা দেখতে চলে এলেন। আমাকে তার রুমে তলব করে বললেন, অনুমতি ছাড়া সাহিত্য চর্চা অপরাধ। সুতরাং বেত দিয়ে হালকার উপর ঝাপসা দিলেন। পরে অবশ্য প্রিন্সিপাল সাহেব আমাদেরটার জন্য স্পিশাল এনাম দেন এবং পরে শিশু একাডেমীর মৌসুমী প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায় পুরস্কারও পায় আমাদের দেয়ালিকা।


দুই.

আমাদের সাথে বজলু নামে এক বিচিত্র স্বভাবের ছেলে ছিল। কয়েক দিন পর পর তার মাথায় আজব সব বুদ্ধি আসতো। একদিন আমারে কইল, শেখু ভাই, আমারে তো এখানে কেউ চিনে না, তুমি ত গান কবিতা ছবি আকা দিয়া সবার কাছে পরিচিত, তুমারে একনামে সবাই চিনে। আমারে একখান বুদ্ধি দেওতো, যাতে একদিনেই সবাই আমারে চিন্যা ফালায়।

হঠাৎ আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি বাইর হইল। কইলাম, বজলু এক কাম কর, বিল্ডিং-টয়লেট গাছপালা সবখানে তোর নাম লিখা দে।


তো পরদিন বোর্ডিং সুপার তার দরবারে আমারে ডাইকা পাঠাইল। গিয়া দেখি বিশাল জমায়েত। মাঝখানে টেবিলেন ওপর পাকা বেত রাখা। বজলুর মুখ শুকনো। কয়েকজন আমারে দেইখা কেলাইল। আমারও কইলজাডা হঠাৎ তড়পাইতে লাগল।


সুপার আমারে দেইখা শক্ত হইয়া গেলেন। মুখ ফিরাইয়া বললেন, বজলু, এই বিল্ডিং ঐ বিল্ডিং টয়লেট গাছ গাছালি সব জায়গায় নাম কি তুইই লিখছোস?


বজলু মিচকা শয়তানের মত চোখ উল্টাইয়া কইল, স্যার! এই লিখনের বূদ্ধি শেখু আমারে দিছে।

আমার তখন যায় যায় অবস্থা। আমি নিজেরে বাচানির জন্য কইলাম, স্যার, আমার কুনু দোষ নাই। বজলু আমারে হাত-পায় ধইরা বুদ্ধি চাইল, কেমনে তার নাম একদিনে ফুটানো যায়। এর লাগি, আমি কইছিলাম নাম লিখতে।

স্যার প্রচন্ড রাগের মধ্যে হঠাৎ হাইসা দিয়া কইলেন। ঠিক আছে, তোরা দুইটাই গিল্টি। এদিক আয়, একটু হাত বুলায়া দেই।


ব্যাস, দশ দশখান বেত হজম করলাম এবং মুফতে বজলুর লগে সারাদিন বালতি পানি নিয়া নাম মুছনের মহৎ কর্মে লিপ্ত হইলাম।

কবিতা-৫



ঘুমিয়ে আছে যিশু!!!!


শেখের পো এক শায়ের লেখে
চলার পথে ছোট্ট একটি শিশু দেখে

উদোম গায়ে শীর্ণ হাতে

হতাশ চোখে চায় না ত সে কিছু
ফুটপাতে তার কোলের ওপর
ঘুমিয়ে আছে যিশু

ক্ষুধার মানিক ঘুমিয়ে গেছে

আধার চারিদিক
যাচ্ছে মানুষ টপকে তাদের
আহা, এড়িয়ে যেন কীট!!! 
###

কবিতা-৪

 

 

কাল রাতে নেমেছিল বৃষ্টিদানা


রাজপথে হাসফাস করা গাড়িগুলো
নির্দয় ঘামছে, রৌদ্রকরে উত্তপ্ত চারদিক
জ্যামের উষ্ঠা খেয়ে দিশেহারা পাবলিক
ঢাকার গরমে গরমিত বাড়িগুলো

রাতেও বিদ্যুৎ নেই, ভাজা ভাজা ছেলে-বুড়ো

শিশু কাঁদে, মায়েরাও কষ্টের শ্বাস ছাড়ে
একটু স্বস্তি নেই, শুধু হাহাকার বাড়ে
চাতকের চাওয়া একটু বৃষ্টির গুড়ো

একটানা কেঁদে চলে চড়ুই ছানা

শেষ রাতে আসে নেমে বৃষ্টিদানা।
###

কবিতা-৩


 

আলমাআতার হারানো পাখি


এক শীতে বলেছিলাম, মাগো! পাকান পিঠা ভেজে রেখো
আমি আসছি..

তারপর প্রজাপতি বসন্ত, কাঠফাটা রোদ্দুর, ঝমঝম বৃষ্টির কলতান শেষে
শরতের তুলো তুলো মেঘের সাথে আবার শীত এলো

আমি আনমনা হই, টেলিফোন তুলে ভাবি, এখনি যাবো
আলমাআতার পাতার নীড়ে, কথাটা মাকে বলি.....
কিন্তু বলা হয় না, কখন যে আমার পাখি উড়ে গেছে..
শুন্য নীড়ে শুধু স্মৃতির পালক

আর আমি বসে ভাবি, মাগো! পাকান পিঠা কি ভেজে রেখেছ....

উৎসর্গ : হৃদয় গভীরে যে পাখি আছে লুকিয়ে
###

কবিতা-২



আলমাআতার পাখি



একদিন পাখি উড়ে এসে বসেছিল বসন্তে এই তরুশাখে

আলমাআতার কান ভারি হয়েছিল আর আন্দুলিয়ার বাতাসে ভেসেছিল কুজন সুমধুর
বসন্ত গেছে কাঠফাটা গরম শেষে বর্ষার ক্রন্দন এখন মনের আকাশে

পাখি উড়ে গেছে দিগন্তে ভাসে বিষাদের সুর

স্বর্গোদ্যানে নরনারীরা আনন্দে মাতে আর যান্ত্রিক কশাঘাতে নির্জীব বনি আদম

সময়ের কাটা টিকটিক করে লিপিবদ্ধ জীবনের খেরোখাতা চষে অবিরাম

দুর্বলেরা চিরকালই পিষ্ট হয় দানবের পদভারে

তবু পথচলা থেমে থাকে কি?

পৃথিবীর নির্বাক দিনগুলো একে একে হারিয়ে যায়

তবু আশা জাগে নতুন ভোরের

রৌদ্র করোজ্জ্বল দিন বুঝি হাতছানি দেয় বিষাদিত মনে

### 

কবিতা-১

ফুলের মেয়ে

ফুল হাতে এক ছোট্ট মেয়ে বাংলামোটর মোড়ে
খেলার সময় পার হল তার ফুল বিক্রি কোরে


রিক্সা-কারে বাড়ি দিয়ে ছোট্ট দুটি হাত
বলে যে তার ছোট ভাইটি কাল খাইনি ভাত


একটা মালা নেন গো সাহেব নেন যদি গো সার
একটা রুটি কিংবা মুড়ি এতেই হবে তার


কেউবা থাকে মুখ ফিরিয়ে কেউবা মারে ঝাড়ি
তবু তো হায় সেই মেয়েটি দেয় না তাতে আড়ি


শীতের ভোরে সবাই যখন কাঁপছে পূবাল বায়
জামের ভেতর একলা মেয়ে হাটছে উদোম গায়


জাম ছুটে যায় রিক্সা গাড়ি হুড়মুড়িয়ে ছোটে
ফুলের মেয়ের বুকে তখন কষ্টগোলাপ ফোটে


এসব দেখে খোকন সোনার উঠল কেঁদে মন
সবুজ গায়ে আছে যে তার এমন একটি বোন

###