শুক্রবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১১

বাঙালা বনাম বাংলা

বাংলা লিপি নিয়ে নতুন করে পড়তে গিয়ে অনেক নতুন বিষয়ে নজর আটকে যাচ্ছে। পড়ার জন্য পড়া আর লেখার জন্য পড়াতে যে ফারাক আছে, এখন তা বেশ ভালই টের পাচ্ছি। বাংলা লিপির ঠিকুজি খুজতে গিয়ে কতগুলো শব্দ পেলাম। বাঙালা, বাঙ্লা, বাঙ্গালা(বাঙ+গালা), বাংলা। অনুরূপ বাঙালী, বাঙ্গালী, বাঙ্লাদেশ, বাঙালা দেশ, বাংলা দেশ, বাংলাদেশ শব্দ দেখতে পেলাম।

এখন আমার হাতে যে বইটি আছে, সেটার প্রথম পৃষ্ঠার কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি,

"বাঙালী'র বাঙালা। এক 'বাঙালী' নয়। দুই 'বাঙালী'। এক 'বাঙালা নয়। দুই 'বাঙালা'। কেবল দুই দেশ নয়। দুই জাতি; দুই ভাষাও। অথচ আমরা অনেকেই জানিনে, অতি পুরানো আমলে, সেই দেশ-দু'টোর একটার নাম ছিল-'বঙ্গাল', 'বঙাল' বা 'বাঙালা'; অপরটার নাম ছিল 'বঙ্গ'। পরে এই 'বঙ্গ' হয় 'গৌড়'। তারও পরে, সেই 'বঙাল' আর 'গৌড়' মিলে হয় 'বাঙালা' বা 'বাঙ্গালাহ্'। সময়টা তখন ইংরেজী ১৩৫১। তার পরও 'বাঙালা' ও 'বাঙালী'র ভাঙা-গড়া হ'য়েছে। তা হ'য়েছে ১৯০৫-এ একবার। ১৯১১-য় একবার। ১৯৪৭-এ এক বার। ১৯৭১-এ আর এক বার। ফলে, দেশের নাম বদলের সাথে সাথে জাতিরও নাম ব'দলেছে বার বার। আর, এভাবেই বাঙালা দেশ, বাঙালা ভাষা, ও বাঙালী জাতির বিকাশ ঘ'টেছে নানা রকম।

তাই আজকের "বাঙ্লাদেশ" আর আগের 'বাঙালা দেশ' এক নয়। আজকের বাঙালী জাতি ও আগেকার বাঙালী জাতির হকিকৎও এক নয়।"

--------------বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস, পৃ-১


১৭০০-১৭৯২ সালের বৃহত্তর বাঙালার ম্যাপ


একই ম্যাপ নিচেরটায় লাল দাগে বাউন্ডারি দেখানো হয়েছে।




"বাংলা" বানানের বিষয়ে কিছু লেখা পেলাম।

ক.
"..অনুস্বারের ধ্বনি বাঙ্গালা ভাষায় "ঙ"-এর উচ্চারণের সহিত অভিন্ন হইয়া দাঁড়ানোর ফলে, "বাঙ্লা" শব্দকে "বাংলা" রূপে লেখা হয়। কিন্তু "বাঙাল-বাঙালী" এই শব্দ-দ্বয়ে অনুস্বার লেখা অসম্ভব।... এতদ্ভিন্ন, সংস্কৃতে অনুস্বারের যে উচ্চারণ ছিল... তাহার বিচার করিলে অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" শব্দের সংস্কৃত মতে উচ্চারণ দাঁড়ায় "বাআঁলা"; উত্তর-ভারতে এখন অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" উচ্চারিত হইবে "বান্ লা" রূপে, দক্ষিণ-ভারতে "বাম্ লা" রূপে। এই সমস্ত কারণে, "ঙ"-দিয়া "বাঙ্লা" লেখাই যুক্তিযুক্ত।"

----------ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়


খ.
"কিন্তু ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যেহেতু এই শব্দের বিশুদ্ধরূপ প্রায় সবখানেই "বাঙ্গালা" লিখেছেন, সেজন্য আমি এ-গ্রন্থের(বাঙালীর লিপি ভাষা বানান ও জাতির ব্যতিক্রমী ইতিহাস) সর্বত্রই "বাংলা", "বাঙ্লা" "বাঙলা" বা "বাংগলা"(ঙ-এর নিচেয় হস্ চিহ্ন না দিলে, তার উচ্চারণ 'বাংগোলা' দাঁড়ায়, আর হস্-চিহ্ন দিলে; তার উচ্চারণ "বাংলা"-র মত) না-লিখে, আধুনিক কালের শুদ্ধ রূপ 'বাঙালা' শব্দরূপ ব্যবহার করেছি। বর্তমান "বাংলাদেশ" বোঝাতে লিখেছি-"বাঙ্লাদেশ"।"

-----------অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান
সাবেক চেয়ারম্যান, বাঙালা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


গ.
ড. হুমায়ুন আজাদ তার লেখা বই-পত্রে সবখানেই "বাংলা" শব্দের অনুস্বারকে "ঙ" দিয়ে 'বাঙলা' লিখেছেন।



ঘ.
আহমদ শরীফ তার বইতে 'বাঙলা' শব্দ "ঙ" দিয়ে লিখেছেন।



ঙ.
ব্লগার 'শনিবারের চিঠি' তার সে-ই আটটি শাশ্বত ডাকটিকেট পোস্টে ডাকটিকেট গুলোর ছবি দিয়েছেন।





এখানে মজার একটি বিষয় আছে, 'বাংলাদেশ' শব্দকে 'বাংলা দেশ' এবং ইংরেজিতেও Bangla Desh লেখা হয়েছে।

আর পোস্টের ভেতর "বাঙলাদেশ" শব্দ "ঙ" দিয়ে লেখা হয়েছে।



প্রথম ছাপানো ১টাকা নোটেও এই ব্যাপার আছে।



এছাড়া দৈনিক আজাদী পত্রিকার ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সংখ্যা মূল হেডিং-এ "জয় বাংলা, বাংলার জয়" লেখা এবং সেটার নিচেই লেখা আছে-"জয় বাঙলা, বাঙলার জয়"



এবিষয়ে পুরাতন ডকুমেন্টগুলো 'বাঙলা' শব্দ দেখাচ্ছে।
এখন জানার বিষয় বিষয় হচ্ছে, কখন থেকে "বাঙলা" শব্দ "বাংলা" শব্দে রুপান্তরিত হল এবং কেন সেটা করা হল?

যেহেতু বাংলা শব্দ দিয়ে বাঙালি বা বাঙ্গালী শব্দ লেখা যায় না। ং-কে ঙ করার কোন বিধান ব্যাকরণে নেই। তাহলে এই প্যাচ বা ত্যানা কিভাবে আমরা পেলাম।

আসেন ভাইয়েরা আলোচনা করি।

ছবি- নেট থেকে মারিং।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন