মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১২

আবির রাঙা মুখ দেখে!




একদিন ঘুরতে বেরিয়েছি। স্কুলের পেছনের রাস্তাটা তখন সবেমাত্র পাকা হয়েছে। এটা দুটো বড় রাস্তার সংযোগ সড়ক। একসময় এটা খাল ছিল। চারপাশে বিশাল বিল ছিল। বাবা-চাচারা প্রচুর মাছ ধরতেন সেখান থেকে। এখন সেখানে উচু উচু বিল্ডিং। রাস্তার উত্তর মাথায় এল টাইপের একটা প্রাচীন বিল্ডিং। লোহার বীম আর পলেস্তারা উঠে যাওয়ায় দেয়ালের কোথাও আগাছা বেড়ে উঠেছে। সেটাতে বিভাগীয় শিশু এডাডেমীর অস্থায়ী অফিস ও প্রশিক্ষণ ক্লাস। সম্ভবত মাইকে অনুষ্ঠানের শব্দ শুনে ভেতরে গিয়েছিলাম কৌতুহল বশে। অনেক ছেলে-মেয়ে আর অবিভাবকদের জটলা। ঈদে মিলাদুন্নবির অনুষ্ঠান। হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক উপস্থাপনা করছেন। হামদ-নাত কেরাত ইত্যাদি প্রতিযোগিতা এবং শেষে মিলাদ।

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি। কোত্থেকে সেই উপস্থাপক এসে আমার সামনে উদয় হলেন। মিলাদ শেষে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। অগত্যা পুরো ভবনটা ঘুরে দেখলাম। দোতলায় পাঠাগার। অনেক বই। গাছ-গাছালি ঘেরা বিশাল চত্ত্বর। ভবনের পেছনে বড় একটা মাঠ, পাশে শান বাধানো শাপলা পুকুর। আমার বেশ পছন্দ হল জায়গাটা। নোটিশ বোর্ডে জাতীয় শিশু কিশোর প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী টানানো। ছবি আকার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগ্রহ হল। অথচ ছবি আকার কিছুই জানিনা। বাসায় এসে পেন্সিল স্কেচ আর জল রং নিয়ে ভাবলাম। পরদিন আবার সেখানে গিয়ে বিষয় দুটো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তেমন কোন সুবিধা হল না।

শেষ পর্যন্ত এইচবি পেন্সিল ইরেজার রুলার আর এক বাকসো ওয়াটার কালার ও আর্ট পেপার নিয়ে প্রতিযোগিতার দিন উপস্থিত হলাম। অবশ্য হাশেম খানের আঁকা ক্লাস থ্রী-ফোরের বাংলা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বাসায় অনুশীলন করেছি।

প্রতিযোগিতায় কার্টিজ পেপারে আঁকতে হল। আমার পাশে এক আপুও আঁকতে বসেছেন। আমার ব্যাপার-সেপার দেখে বললেন, আজকে প্রথম এসেছ বুঝি। আমি হ্যা বলতে তিনি অভয় দিলেন। তখন শীতের সময়, বিষয় ছিল খেজুর গাছে রসের হাড়ি এবং গাছীর কর্মকাণ্ড। আপু অন্য গ্রুপের, তাই আমাকে টুবি থ্রিবি পেন্সিল দিয়ে আকার নিয়ম এবং লাইট-শেড দেখালেন। আমি বেশ মজা পেলাম এবং অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি আঁকাটা ধরতে পারলাম। শেষ পর্যন্ত পেন্সিল স্কেচে শুধু সুবিধা করতে পেরেছি। জল রংয়ে ভুত মার্কা ছবি আঁকলাম। ফলাফল পেন্সিল স্কেচে দ্বিতীয়। তো সেই আপু আমাকে একাডেমির ছবি আঁকার স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। পরের সপ্তাহ থেকে প্রশিক্ষণ ক্লাসে নিয়মিত হলাম। এরপরের প্রতিযোগিতা গুলোয় পুরস্কার একটা না একটা জুটেই যেত। কিন্তু অন্যদিকে হল ভিন্ন রকমের সমস্যা।

ছবি আঁকাটা নেশার মত হয়ে গেল। পড়াশুনার চেয়ে ছবি আঁকা চলছে বেশি। কি করে যেন মুন্নী তা জানতে পেল। শিশু একাডেমিতে মেয়েরা তুলনামূলক বেশি। মুন্নীর এসব পছন্দ না। মাঝে মাঝে রাগ করে কথা বলে না, দেখা দেয় না। কিন্তু আমার আঁকা-আকি তাতে থামে না। আসলে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মনের পর্দায় দেখা ছবির পোট্রেট যে আঁকা চলছে, তা কেউ জানে না। আমি আঁকি আর ছবির সাথে কথা বলি। কখনও ছবি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। অভিমান করে আর আমি হাসি।

ক্লাসে স্যার কাপড়ে করা নকশা এঁকে আনতে বললেন। বিশেষকরে কাশ্মীরী শালের নকশার কথা বললেন। আমি কোথায় পাব এ নকশা! হঠাত মনে পড়ল মুন্নীর মায়ের একটা গাঢ় লাল কাশ্মীরী শাল আছে। সুতরাং মান-অভিমান ভাঙ্গিয়ে শাল যোগাড় করার মজাটা টের পেলাম। কারো দিকে নজর করব না এমন শপথ করে শালটা মিলল।

আমার নকশাটা এ্যাওয়ার্ড পেল। খুশিতে চোখ ভিজে গিয়েছিল।

বিকেলে শালটা ফেরত দেয়ার সময় সুখবরের সাথে লাল গোলাপ দিলাম। হায়! মুন্নীও দেখি কাঁদছে। সেই আবির রাঙা মুখে যেন চাঁদের আলোর বান ডেকেছে।

চলবে-

১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব

সোমবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১২

একটা চোর কাটা!




সার্কিট হাউজের পাশে স্টেডিয়াম। ফুটবল খেলা দেখতে প্রায়ই যেতাম সেখানে। পাশে জিপিও। স্ট্যাম্প জমানোর বাতিক ছিল। স্বাধীনতার প্রথম আটটি ডাক টিকেট সেখানকার ফিলাটেলিক ব্যুরো থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। একবার ফুটবল খেলার সময় পটকার আঘাতে এক তারকা ফুটবলার মারাত্নক আহত হয়েছিলেন। সে দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। এই স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হত। কখনও সার্কিট হাউজ ময়দানেও হত। বৃষ্টির সময় সার্কিট হাউজ মাঠে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলে মাইট্যা ভুতের রূপ হত আমাদের। এরপর নদীতে গিয়ে দস্যিপণা চলত।

সেবার স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানটার জন্য স্পিশাল আগ্রহ ছিল। আগেভাগেই স্টেডিয়ামে গিয়েছি। মূল প্যান্ডেলে কায়দা করে আসন বাগিয়েছি। মার্চ পাস্টে একেক দল আসছে, সালাম দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মুন্নির স্কুলের কুসুম রঙা ড্রেস পরা দল এল। মুন্নিকে দেখলাম প্যান্ডেলের কাছের লাইনে। সালাম দেয়ার সময় হঠাৎ চোখাচুখি। হেসে চোখ টিপে দিল। আমার কান গরম হয়ে উঠল। আশেপাশে তাকালাম আমাকে কেউ দেখল কিনা। নাহ, এসবে কারো নজর পড়েনি। মনের ভেতর তখন শিরশিরে অনুভূতি। মার্চ পাস্টের পর স্কুলগুলোর ড্রিল। মুন্নি বেশ ভালই ড্রাম বাজাল তাদের ড্রিলের সময়। ড্রিল শেষে জটলা করে দেড়-দুইশ গজ দূরে দাড়িয়ে আছে ওরা। মুন্নিকে দেখা যাচ্ছে না। আমি প্যান্ডেলের দক্ষিণ পাশে গেলাম। হঠাৎ দেখি সে জটলার একপাশে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা চুলকানোর ভান করে সেলুট দিতেই সেও সেলুট দিল। এভাবে কয়েকবার চলল। ওরা মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি গ্যালারির ফাকা জায়গা খুজে বসে পড়লাম। আমাকে তখন যেন কি এক ভাল লাগা বিভোর করে ফেলেছে। ধীরে ধীরে মাঠ ফাকা হয়ে গেল। কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না।

বিকেলে মাঠে গিয়েছি। সবাই খেলছে। আমার ইচ্ছে করছে না। হাটাহাটি করছি আর চোরা চোখে দেখছি জানালাটা খুলে কিনা। সন্ধ্যা নেমে আসছে। অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি নাকে দড়ি বাধা একটা গাধা। কিছুটা বিরক্তিও লাগছে। ধুর ছাই বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। এবার জানালা বন্ধের শব্দ পেলাম। চেয়ে দেখি বন্ধ জানালা। কয়েক পা এগিয়েছি আবার শব্দ। এবার তাকিয়ে দেখি বন্ধ। মেজাজটা পুরাই হট হয়ে গেল। জোরে পা চালালাম। দৃষ্টির শেষ সীমায় প্রায় পৌছে গেছি। নিজের অজান্তেই আরেকবার তাকালাম আড়চোখে। দেখি, জানালায় একটি দুখি মুখ। কিন্তু আমার তখন ভেতরে রাগে পুড়ছে। যেন কিছুই দেখিনি এমন ভাব করে চলে এলাম।

রাতে ঘুম আসছে না। কেবলি একটি মুখ ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। যতই না না করি, ছবিটি মুছে যায় না। বুকের ভেতর একটা অচেনা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। একসময় মনে হল একটা চোর কাটা বিধেছে বুকে। আর সেই কাটাটা হচ্ছে মুন্নী নামের একটা দুরন্ত মেয়ে।


চলবে-


১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব







[সকালে বাইক নিয়ে কাকরাইলের জ্যামে জমে আছি, তখন মুঠোফোনে একটা খবর পেলাম, আমার প্রিয় স্যার(মুন্নীর বাবা) কয়েকমাস আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আমার ধারণা ছিল, হয়ত সাথে সাথে খবরটা আমাকে জানান হবে। কারণ, গত বছর স্যারকে শেষবার যখন দেখে এসেছি, আমার সেল নম্বর দিয়ে এসেছিলাম। এছাড়া আমার বিশ্বাস, মুন্নীর কাছে আমার নম্বরটা আছে। অন্তত সে ত খবরটা দিতে পারত। আজ সারাদিন ভীষণ মন খারাপ।]

এই ব্রাকেটের লেখাটুকু শুধু মুন্নীর জন্য। লেখাটা সে যখন পড়বে, বুঝতে পারবে তাকে আমি কী বলতে চেয়েছি।

 মুন্নীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা-
আমার এক ক্লাসমেট যে সংবাদটা দিয়েছিল, সেটা ভুল ছিল। তাকে আরেকজন খবরটা দিয়েছিল।

অবশেষে অনেক চেষ্টার পর জানতে পারলাম, আমার শ্রদ্ধেয় স্যার বেঁচে আছেন এবং সুস্থ আছেন। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মুন্নীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

বুধবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১২

কী লিখি তোমায়!





একটু আগেভাগেই রাতের খাবারটা শেষ করে বেডরুমে এসেছি। জানালা দিয়ে জোছনার ঢল নেমেছে মেঝেতে। কিন্তু সেদিকে নজর করার ফুরসত কোথায়! মাথায় তখন একটাই চিন্তা। একটা কবিতা নামাতে হবে আজ রাতেই। অথচ সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। এমন বিপদে এর আগে কখনও পড়িনি।

খাতা কলম নিয়ে বসলাম। থুতনি চুলকাই, মাথা চুলকাই। কিন্তু কবিতা আসেনা। কিছুক্ষণের মধ্যে মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল। অন্যদিকে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়েছে। সে এক বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার। ধুরছাই, কাল স্কুলেই যাব না!

কিন্তু তাতে কোন সমাধান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে অজানা এক ব্যথা টের পাই। গলার কাছে কী যেন আটকে আসছে। বৃষ্টি নামে চোখে। আমি অবাক হয়ে বসে থাকি।

মনের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, কী হল তোমার! কিছু একটা লিখে ফেল। মনের আয়নায় সেই আকুতি ভরা মুখ ভেসে ওঠে। আমি সম্মোহিতের মত লিখে যাই।

কী লিখি তোমায়
বাতাসে ভেসে আসা সুর
দোয়েলের শীষ আর দীঘির কেঁপে ওঠা জল
আমার ভাল লাগা সব দিলাম তোমায়


আসলে লিখতে চেয়েছিলাম, আমার ভালবাসা সব দিলাম তোমায়। কিন্তু কি এক শরম এসে জড়িয়ে ধরে, হাত অবশ হয়। কয়েকবার লিখতে গিয়েও তা লেখা হল না। এইটুকু লিখেছি এসময় ফজরের আজান ভেসে এল। ঘুম নেমে আসে চোখে।

আম্মুর ডাকাডাকিতে জেগে উঠি। স্কুলের সময় হয়ে গেছে। আজ প্রাকটিক্যাল ক্লাশ আছে। শেষ ঘন্টায় কেমিস্ট্রি স্যারের ক্লাশ নেয়ার কথা। তিনি দপ্তরিকে পাঠালেন আজ ক্লাশ হবে না। বন্ধুরা মেতে উঠেছে গান কবিতায়। আর জানালা দিয়ে আমি তাকিয়ে আছি মাঠের ওপারে রেন্ট্রি তলায় প্রাইমারির ছাত্রীদের জটলার দিকে। সেখানে লালে মেশানো ক্রিম কালারের ওড়না মাথায় একটা পরী চালতার আচার কিনছে।

স্কুল থেকে ইলা দৌড়ে সেখানে গেল। দুই বোনের আচার খাওয়া চলছে। কিছুক্ষণ পর প্রাইমারীর বারান্দা দিয়ে উত্তর প্রান্তে এসে থামল তারা। এবার ইলা এগিয়ে এসে আমাকে বলল, ভাইয়া, বইটা এনেছ ত। এক্ষুনি দেও। আপুর তাড়া আছে। আমি বইটা তার হাতে দিতেই দৌড়ে চলে গেল।

মুন্নি বইটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাড়ালো অন্যদিকে মুখ করে। যেন কিছুই হয়নি। বুঝা যাচ্ছে কিছু একটা খুজছে সে বইয়ের ভেতর। হঠাৎ মুহুর্তের জন্য আমার দিকে ফিরে তাকাল। আমি ভেজা চোখের এক অপার্থিব চেহারা দেখতে পেলাম। যেন পৃথিবীর সবটুকু খুশি সেই মুখে এসে জমেছে। তারপর তাড়া খাওয়া হরিণীর মত সে ছুটে পালাল।

চলবে-

 ১ম পর্ব

২য় পর্ব

মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

তাকে নিয়ে প্রথম লেখার যন্ত্রণা!!




স্কুলের বিজ্ঞান ভবনটির সামনে সার বাধা নারকেল আর মেহগনি। তারপরে বিশাল মাঠ। মাঠের ওপাশে শতবছরের রেনট্রি জাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। সেখানে বাদাম আর আচারওলাকে ঘিরে প্রাইমারির ছাত্রীদের জটলা। আমাদের বায়োলজি ও কেমিস্ট্রির প্রাকটিক্যাল কক্ষটি ছিল ভবনের পশ্চিম মাথায় নিচতলায়। ল্যাবরেটরি ও ক্লাস একই সাথে। পশ্চিম দেয়ালে পাঁচটি আলমিরায় যন্ত্রপাতি আর রাসায়নিক দ্রব্য। উত্তর আর দক্ষিণ পাশে পুরো দেয়াল জুড়ে জানালা। পূর্ব পাশে দেয়ালে বিশাল ব্লাকবোর্ড। প্রায় হলরুমের মত বড় এই প্রাকটিক্যাল ক্লাসে আমরা কখনও দুই-তিন ঘন্টা পর্যন্ত মগ্ন থাকতাম।

প্রাকটিক্যাল ক্লাসের দক্ষিণ পাশে বারান্দার পর উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্য বরাবর প্রাইমারি স্কুল। বারান্দার পর ক্লাসটি পঞ্চম শ্রেণীর। প্রায়মারির পূর্বমুখি বারান্দা। মুন্নির মেজো বোন ইভা ফাইভে পড়ে আর ছোট বোন ইলা টুতে। সুতরাং প্রায়ই দুপুরের দিকে মুন্নি সেখানে আসত। আমরা বাদর কমিটি প্রাকটিক্যাল ক্লাসে গান-কবিতা-কৌতুকে জমিয়ে তুলতাম। প্রাইমারির ছাত্র-ছাত্রীরা জানালায় ভীড় করে এসব উপভোগ করত।

তো চিরকুট প্রাপ্তির পর হঠাৎ উপলব্ধি করলাম মুন্নি যেন আমাকে দেখতেই প্রাকটিক্যাল ক্লাসের সামনে আসে। কিন্তু ভাব দেখায় যেন তার বোনের কাছে এসেছে। বিষয়টা অন্যরা খেয়াল করেনি যদিও, কিন্তু আমার কলজে শুকিয়ে যায়। সপ্তাহে তিনদিন প্রাকটিক্যাল ক্লাস এবং দেখলাম সেই তিনদিনই সে এসেছে। এরকম দু'সপ্তাহ খেয়াল করার পর মনে হল প্রাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য আমার ভেতরটাও ছটফট করে। আরে! আমি কি তলিয়ে যাচ্ছি নাকি!

বার বার থু থু ফেলার ছলে বারান্দায় আসি। আমাকে দেখে তার চেহারায় গোলাপী রঙ ধরে। চোখের ভাষা বদলে যায়, তারপর হঠাত অন্যদিকে হাটা শুরু করে। কী করব বুঝতে পারি না। কী করা উচিত তাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।

একদিন রাকিব এসে বলে, তোমার গ্রামারটা একটু দাও ত। আমি কেপে উঠি। বলি, আজকে সাথে নেই। কালকে এসো।

বাসায় ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ি। কিছুই ভাল লাগছে না। চোখ বুজে আকাশ-পাতাল ভাবছি। হঠাৎ কপালে আম্মুর হাত। কি রে এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ!

মাকে কিভাবে বুঝাই যে আমি বড়শিতে গেঁথে গেছি। মুখে বলি, না তেমন কিছু না, একটু হয়রান লাগছে। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে আসতে বলে আম্মু রান্না ঘরে ঢোকেন। আসলে আমার খেতেও ইচ্ছে করছে না, অথচ পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে।

বিকেলে মাঠে গেলাম না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে তখন ছবির পর ছবি ভেসে চলেছে। পরীর মত একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়াচ্ছে, হেসে লুটিয়ে পড়ছে, কখনো দৌড়াতে গিয়ে ধপাস করে পড়ছে, হাত ধরে তুলে দিতেই ফিক করে হেসে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কখনও দুম করে পিঠে কিল বসিয়েই দৌড়। কখনও গল্প শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে একটি চাঁদ মুখ।

সেই মুখটি আজ বার বার কেন ভেসে উঠছে মনে। আমি জানি না এটা কি জন্য হচ্ছে। এই অদ্ভুত অনুভূতির সাথে আমি পেরে উঠছি না। আমার শুধু মনে হচ্ছে, আজ একটা কবিতা লিখতে হবে। কিন্তু কি লিখব, কিছুই মনে আসছে না।

পড়ার টেবিলে কবিতার খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখি। ছড়া টাইপ পদ্য। হাবিজাবি নিয়ে লেখা।

কা কা ডাকে কাকের ছা
কাকের মায়ে কই
ক্ষিধের চোটে পরাণ গেল
আনো চিড়ে দই।


কিংবা

উডডুম গুডডুম কী যে বাজে
পান্তা বুড়ির নাতনী সাজে
নাতনী যাবে মেলাতে
পুতুল নাচের খেলাতে।



খাতা বন্ধ করে উঠে পড়ি। সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণ পর। হাটতে হাটতে মাঠে এসে পড়ি। ক্রিকেট খেলা প্রায় শেষ। মাঠের ওপাশে একটি জানালা শব্দ করে বন্ধ হয়। তাকিয়ে দেখি ধীরে ধীরে আবার খুলছে সেটা এবং সেখানে একটি বিষন্ন মুখ তাকিয়ে আছে এদিকে।

আমি কি করব ভেবে পাইনা। মসজিদে আজান হচ্ছে। বাসার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার জানালায় তাকাই। এবার হাসিতে ঝলমল করে ওঠে সে। তারপর হঠাৎ ভেংচি কেটে জানালা বন্ধ হল।

চলবে-


১ম পর্ব

ছবি-নেট থেকে

রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

কেন যে তাকে লিখেছিলাম!




হাইস্কুলের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি। রক্ত টগবগ করে। কিছু একটা করে দেখাবার দুর্দমনীয় ইচ্ছাটা খোচাখুচি করে মনে। নাকের নিচে হালকা কালো রেখার জন্য মাঝে মধ্যে শরম লাগে। স্কুল শেষে সারাদিন বাদরামি আর খেলা। যে মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতাম, তার পাশেই শিক্ষকদের কোয়ার্টার।

আমাদের অংক স্যার মাঝে-মধ্যে বাংলা ক্লাশও নিতেন। তার বাংলা ক্লাশ আমরা খুব উপভোগ করতাম। স্যারের রবীন্দ্র আর নজরুলের অধিকাংশ কবিতা মুখস্ত ছিল, এছাড়া সংস্কৃত ভাষার ওপরও দখল ছিল বেশ, প্রাচীন অনেক কবিতা যার একেকটার দৈর্ঘ্য মাইলখানেক হতে পারে, সেগুলো প্রায়ই বলতেন।

একদিন ক্লাশে ছাত্রদের মধ্যে একজনকে লক্ষ্য করে বললেন, ছোটকু! তোর মন কোথায় রেখে এসেছিস? বাইরে ওভাবে তাকিয়ে কি ভাবছিস!

ছোটকু দেখি শরমে লাল! আমরা বুঝলাম ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।

স্যার এবার ছড়া কেটে বললেন,

বিধি এক চিতে ভাবিতে ভাবিতে নিরমাণ করিলেন 'পি'
রসের সাগর মন্থন করিয়া উপযিল তাহে 'রি'
মথিতে মথিতে অমিয়া উঠিল ভিজাইল তাহে 'তি'
যার মরমে পশিল যতনে এ তিন অক্ষর সার
ধরম-করম-শরম-ভরম কিবা জাতি কুল তার


এরপর ক্লাশে কাচা পিরিতি বিষয়ে উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ বয়ানের পর বয়ান এবং আমাদের নজরকে লেখাপড়ায় নিমগ্ন করতে নির্দেশের পর ছোটকুকে শাষিয়ে দিলেন, এরপর বচন নয় হাত বুলিয়ে দেবেন। শুধু ছোটকু নয় আমাদের সবারই কলজে শুকিয়ে গেল। কারণ স্যারের হাত বুলানো যে একবার খেয়েছে, সেই জানে।

তো স্যার আমাকে একটু বেশী স্নেহ করতেন। ক্লাশে বাদরকুল শিরমনি হলেও পরীক্ষায় প্রথমস্থানটা কিভাবে যেন দখলে থেকে যেত। হাতের লেখাটাও সবাই পছন্দ করত এবং বার্ষিক দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ধরে সেরা সাফল্য আলাদা খাতির এনে দিয়েছিল ছাত্র মহলে।

অংক স্যারের বাসায় প্রায়ই তলব পড়ত। স্যার গিন্নি ছিলেন কোয়ার্টারে সেরা সুন্দরী। তিনি স্যারের সাথে প্রেম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু স্যারকে প্রায়ই বলতেন, তোমার মধুর কথায় ভুলে আমার সব হয়েছে শেষ। এ সংসারে এসে কোন শান্তি পেলাম না। এরপর আমাদের দিয়ে খাট চেয়ার টেবিল ঘরের একপাশ থেকে আরেক পাশে সাজাতেন। তিন-চার মাস পর পর এই চাকরি আমরা করতাম চিড়ের নাড়ু, নারকেল কুরা দিয়ে গুড়মুড়ি, কখনো মুরগি ভোজের বিনিময়ে। স্যারের আমাদের বয়সি ছেলেটাও একাজে হাত লাগাত। আমরা পাঁচ-ছয়জনের বান্দর কমিটি বছরে তিন-চারবার এই পিকনিক করতাম। স্যার গিন্নিকে আমরা খালাম্মা ডাকতাম। খালাম্মার ঠাণ্ডার সমস্যা ছিল। এজন্য প্রায়ই হোমিও ওষুধ আনতে শহরের উপকন্ঠে আমাকে যেতে হত।

এভাবে চলছিল বেশ। স্যারের তিন কন্যার সাথে আমাদের কোন ঝামেলা ছিল না। বড় কন্যার কথা কি বলব! একটা হরিণ শিশুর মত যে মেয়ে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াত, দেখতে দেখতে সে বড় হয়ে গেল। ক্লাশ ফাইভে উঠে সে আর তেমন ঘরের বাইরে আসে না। দরজায় দাড়িয়ে আমাদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা দেখে।

বন্ধুদের তিনজন অন্য শহরের স্কুলে চলে যাওয়ায় বান্দর কমিটি ভেঙ্গে গেছে। আগের মত স্যারের বাসায় হুটহাট যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। একদিন খালাম্মার তলব পেয়ে বাসায় গিয়ে শুনলাম, বড় কন্যার ভীষণ জ্বর। নতুন বাজার থেকে ওষুধ আনতে হবে। ঘরের ভেতর আমি বেকুবের মত দাড়িয়ে আছি। খালাম্মা রান্না ঘরে গেছেন। খাটের ওপর কাঁথাগায়ে শুয়ে আছে মুন্নি। কপালে পানি পট্টি। চোখ মুদে আছে।

হঠাৎ ক্ষীণ কন্ঠে পানি চাইল সে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটি এগিয়ে দিলাম। কিন্তু পানি খাইয়ে দিতে হল। প্রায় অষ্পষ্ট এক আকুতি নিয়ে বলল, ভাইয়া! কপালে একটু হাত দিয়ে ছুয়ে দেও না! তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভেতরটা কেঁপে উঠল।

সেদিন ওষুধ আনতে গিয়ে হাটতে হাটতে মনে হল, আমার যেন কিছু একটা ওলট-পালট হয়ে গেছে।

ওষুধ দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে এলাম। স্কুল শেষে ঘুরপথে বাসায় ফিরি। কেমন যেন ধরা পড়ার ভয়।

কয়েকদিন পর স্যারের ছেলে রাকিব আমার ইংরেজি গ্রামার বইটা ক্লাসে দিয়ে গেল। মুন্নি অনেক আগে নিয়েছিল কি একটা রচনা লেখার জন্য। রাতে শোবার আগে বই গোছাতে গিয়ে গ্রামারের ভেতর থেকে একটা চিরকুট বেরিয়ে পড়ল।

"ভাইয়া! তুমিতো কত কবিতা লেখ। আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লেখ না।"


ক্লাশ সেভেনের একটা মেয়ে এসব কি লিখছে! তাকে নিয়ে কেন কবিতা লিখতে হবে!

অনেক ভেবে কোন কুল কিনারা না পেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গভীর রাতে হঠাৎ জেগে উঠি। এক অদ্ভুত অনুভূতি। চারদিকে শব্দেরা উড়ে বেড়াচ্ছে আর বলছে, তাকে নিয়ে কবিতাটা লিখছ না কেন!!

হঠাৎ আমার চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে, খুব লজ্জা লাগে। শরমে বালিসে মুখ গুজে দেই।


চলবে-


উৎসর্গ- না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সেই তাকে।

ছবি- নেট থেকে।

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১২

মাতাল হাওয়ার প্রেমে




গ্রাম থেকে ফিরে এসে কিছুই ভাল লাগছে না। সারাটা পথ নস্টালজিয়ায় ডুবেছিলাম।

দুইদিন ধরে বিভিন্ন ভাষার গান শুনছি। হঠাৎ বাংলা গানের মত কিছু গান পেলাম। ভাষাটা বোধগম্য না হলেও সুর এবং মিউজিক একেবারে বাংলা স্টাইল। নেটে খোজ করে দেখি ভারতের কেরালা হচ্ছে এই গানের ভাণ্ডার। মালায়ালাম ভাষায় চমৎকার সব গান। আমাদের ক্লোজাপ তারকার মত ওখানেও তরুণ শিল্পীদের গান হৃদয় ছুয়ে যায়।

এই তরুণ শিল্পীদের একজন ফাসিলা বানু

ফাসিলার ট্রেডিশনাল একটি গান

http://www.youtube.com/watch?v=SImSVSn6VEI&feature=related






আরেক জন শিল্পী সুরুমী

http://www.youtube.com/watch?v=5fJZ1s22Zzs&NR=1&feature=endscreen






ফাসিলার আরেকটি গান


http://www.youtube.com/watch?v=IJKBqOvQPFs&feature=related





সাজিলা সালিম তরুণ শিল্পী তারকাদের অন্যতম। তার একটি হৃদয় ছুয়ে যাওয়া গান

http://www.youtube.com/watch?v=UaN2tBTkiHI






ফাসিলার আরেকটি হিট গান

http://www.youtube.com/watch?v=fys5ZeEDFhk&feature=fvwrel






এবং আরো একটি

http://www.youtube.com/watch?v=-kA00xQixXs&feature=related






ফাসিলার সেই গানটি

http://www.youtube.com/watch?v=i78NLuilVjs&feature=related






একজনকে খুব মনে পড়ে, যে ছিল ফাসিলারই ফটোকপি। তাকে এই পোস্ট উৎসর্গ করলাম।

 ফাগুনের ফুলগুলি হেসেছিল সেইদিন
পাপিয়ার সুরে উতল হাওয়া
মাহবুবার মন ভেসেছিল
হায়! ভুলেছিল নাওয়া-খাওয়া


সব ছিল তার
আলো ঝলমল দিন
মাতাল হাওয়ার গানে
মল্লিকারা দোলে


অপেক্ষার জ্বালা সয়না যে আর
প্রিয় পাখিটি বুঝি
এখনি আসে


আমিও ছুটে যাব ভেবে
মেলেছি পাখা


হায়! সব আছে
ফুলে ফুলে ভরা সাজানো বাসর
শুধু নেই আজ সে
কখনো বলবেনা আর
ওগো! কর না একটু আদর!!