রবিবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১২

কেন যে তাকে লিখেছিলাম!




হাইস্কুলের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি। রক্ত টগবগ করে। কিছু একটা করে দেখাবার দুর্দমনীয় ইচ্ছাটা খোচাখুচি করে মনে। নাকের নিচে হালকা কালো রেখার জন্য মাঝে মধ্যে শরম লাগে। স্কুল শেষে সারাদিন বাদরামি আর খেলা। যে মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতাম, তার পাশেই শিক্ষকদের কোয়ার্টার।

আমাদের অংক স্যার মাঝে-মধ্যে বাংলা ক্লাশও নিতেন। তার বাংলা ক্লাশ আমরা খুব উপভোগ করতাম। স্যারের রবীন্দ্র আর নজরুলের অধিকাংশ কবিতা মুখস্ত ছিল, এছাড়া সংস্কৃত ভাষার ওপরও দখল ছিল বেশ, প্রাচীন অনেক কবিতা যার একেকটার দৈর্ঘ্য মাইলখানেক হতে পারে, সেগুলো প্রায়ই বলতেন।

একদিন ক্লাশে ছাত্রদের মধ্যে একজনকে লক্ষ্য করে বললেন, ছোটকু! তোর মন কোথায় রেখে এসেছিস? বাইরে ওভাবে তাকিয়ে কি ভাবছিস!

ছোটকু দেখি শরমে লাল! আমরা বুঝলাম ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।

স্যার এবার ছড়া কেটে বললেন,

বিধি এক চিতে ভাবিতে ভাবিতে নিরমাণ করিলেন 'পি'
রসের সাগর মন্থন করিয়া উপযিল তাহে 'রি'
মথিতে মথিতে অমিয়া উঠিল ভিজাইল তাহে 'তি'
যার মরমে পশিল যতনে এ তিন অক্ষর সার
ধরম-করম-শরম-ভরম কিবা জাতি কুল তার


এরপর ক্লাশে কাচা পিরিতি বিষয়ে উপমা-উৎপ্রেক্ষাসহ বয়ানের পর বয়ান এবং আমাদের নজরকে লেখাপড়ায় নিমগ্ন করতে নির্দেশের পর ছোটকুকে শাষিয়ে দিলেন, এরপর বচন নয় হাত বুলিয়ে দেবেন। শুধু ছোটকু নয় আমাদের সবারই কলজে শুকিয়ে গেল। কারণ স্যারের হাত বুলানো যে একবার খেয়েছে, সেই জানে।

তো স্যার আমাকে একটু বেশী স্নেহ করতেন। ক্লাশে বাদরকুল শিরমনি হলেও পরীক্ষায় প্রথমস্থানটা কিভাবে যেন দখলে থেকে যেত। হাতের লেখাটাও সবাই পছন্দ করত এবং বার্ষিক দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতায় কয়েক বছর ধরে সেরা সাফল্য আলাদা খাতির এনে দিয়েছিল ছাত্র মহলে।

অংক স্যারের বাসায় প্রায়ই তলব পড়ত। স্যার গিন্নি ছিলেন কোয়ার্টারে সেরা সুন্দরী। তিনি স্যারের সাথে প্রেম করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু স্যারকে প্রায়ই বলতেন, তোমার মধুর কথায় ভুলে আমার সব হয়েছে শেষ। এ সংসারে এসে কোন শান্তি পেলাম না। এরপর আমাদের দিয়ে খাট চেয়ার টেবিল ঘরের একপাশ থেকে আরেক পাশে সাজাতেন। তিন-চার মাস পর পর এই চাকরি আমরা করতাম চিড়ের নাড়ু, নারকেল কুরা দিয়ে গুড়মুড়ি, কখনো মুরগি ভোজের বিনিময়ে। স্যারের আমাদের বয়সি ছেলেটাও একাজে হাত লাগাত। আমরা পাঁচ-ছয়জনের বান্দর কমিটি বছরে তিন-চারবার এই পিকনিক করতাম। স্যার গিন্নিকে আমরা খালাম্মা ডাকতাম। খালাম্মার ঠাণ্ডার সমস্যা ছিল। এজন্য প্রায়ই হোমিও ওষুধ আনতে শহরের উপকন্ঠে আমাকে যেতে হত।

এভাবে চলছিল বেশ। স্যারের তিন কন্যার সাথে আমাদের কোন ঝামেলা ছিল না। বড় কন্যার কথা কি বলব! একটা হরিণ শিশুর মত যে মেয়ে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়াত, দেখতে দেখতে সে বড় হয়ে গেল। ক্লাশ ফাইভে উঠে সে আর তেমন ঘরের বাইরে আসে না। দরজায় দাড়িয়ে আমাদের ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা দেখে।

বন্ধুদের তিনজন অন্য শহরের স্কুলে চলে যাওয়ায় বান্দর কমিটি ভেঙ্গে গেছে। আগের মত স্যারের বাসায় হুটহাট যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছি। একদিন খালাম্মার তলব পেয়ে বাসায় গিয়ে শুনলাম, বড় কন্যার ভীষণ জ্বর। নতুন বাজার থেকে ওষুধ আনতে হবে। ঘরের ভেতর আমি বেকুবের মত দাড়িয়ে আছি। খালাম্মা রান্না ঘরে গেছেন। খাটের ওপর কাঁথাগায়ে শুয়ে আছে মুন্নি। কপালে পানি পট্টি। চোখ মুদে আছে।

হঠাৎ ক্ষীণ কন্ঠে পানি চাইল সে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটি এগিয়ে দিলাম। কিন্তু পানি খাইয়ে দিতে হল। প্রায় অষ্পষ্ট এক আকুতি নিয়ে বলল, ভাইয়া! কপালে একটু হাত দিয়ে ছুয়ে দেও না! তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভেতরটা কেঁপে উঠল।

সেদিন ওষুধ আনতে গিয়ে হাটতে হাটতে মনে হল, আমার যেন কিছু একটা ওলট-পালট হয়ে গেছে।

ওষুধ দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে এলাম। স্কুল শেষে ঘুরপথে বাসায় ফিরি। কেমন যেন ধরা পড়ার ভয়।

কয়েকদিন পর স্যারের ছেলে রাকিব আমার ইংরেজি গ্রামার বইটা ক্লাসে দিয়ে গেল। মুন্নি অনেক আগে নিয়েছিল কি একটা রচনা লেখার জন্য। রাতে শোবার আগে বই গোছাতে গিয়ে গ্রামারের ভেতর থেকে একটা চিরকুট বেরিয়ে পড়ল।

"ভাইয়া! তুমিতো কত কবিতা লেখ। আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লেখ না।"


ক্লাশ সেভেনের একটা মেয়ে এসব কি লিখছে! তাকে নিয়ে কেন কবিতা লিখতে হবে!

অনেক ভেবে কোন কুল কিনারা না পেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। গভীর রাতে হঠাৎ জেগে উঠি। এক অদ্ভুত অনুভূতি। চারদিকে শব্দেরা উড়ে বেড়াচ্ছে আর বলছে, তাকে নিয়ে কবিতাটা লিখছ না কেন!!

হঠাৎ আমার চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে, খুব লজ্জা লাগে। শরমে বালিসে মুখ গুজে দেই।


চলবে-


উৎসর্গ- না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সেই তাকে।

ছবি- নেট থেকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন