মঙ্গলবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১২

আবির রাঙা মুখ দেখে!




একদিন ঘুরতে বেরিয়েছি। স্কুলের পেছনের রাস্তাটা তখন সবেমাত্র পাকা হয়েছে। এটা দুটো বড় রাস্তার সংযোগ সড়ক। একসময় এটা খাল ছিল। চারপাশে বিশাল বিল ছিল। বাবা-চাচারা প্রচুর মাছ ধরতেন সেখান থেকে। এখন সেখানে উচু উচু বিল্ডিং। রাস্তার উত্তর মাথায় এল টাইপের একটা প্রাচীন বিল্ডিং। লোহার বীম আর পলেস্তারা উঠে যাওয়ায় দেয়ালের কোথাও আগাছা বেড়ে উঠেছে। সেটাতে বিভাগীয় শিশু এডাডেমীর অস্থায়ী অফিস ও প্রশিক্ষণ ক্লাস। সম্ভবত মাইকে অনুষ্ঠানের শব্দ শুনে ভেতরে গিয়েছিলাম কৌতুহল বশে। অনেক ছেলে-মেয়ে আর অবিভাবকদের জটলা। ঈদে মিলাদুন্নবির অনুষ্ঠান। হালকা-পাতলা গড়নের এক লোক উপস্থাপনা করছেন। হামদ-নাত কেরাত ইত্যাদি প্রতিযোগিতা এবং শেষে মিলাদ।

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি। কোত্থেকে সেই উপস্থাপক এসে আমার সামনে উদয় হলেন। মিলাদ শেষে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। অগত্যা পুরো ভবনটা ঘুরে দেখলাম। দোতলায় পাঠাগার। অনেক বই। গাছ-গাছালি ঘেরা বিশাল চত্ত্বর। ভবনের পেছনে বড় একটা মাঠ, পাশে শান বাধানো শাপলা পুকুর। আমার বেশ পছন্দ হল জায়গাটা। নোটিশ বোর্ডে জাতীয় শিশু কিশোর প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী টানানো। ছবি আকার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগ্রহ হল। অথচ ছবি আকার কিছুই জানিনা। বাসায় এসে পেন্সিল স্কেচ আর জল রং নিয়ে ভাবলাম। পরদিন আবার সেখানে গিয়ে বিষয় দুটো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তেমন কোন সুবিধা হল না।

শেষ পর্যন্ত এইচবি পেন্সিল ইরেজার রুলার আর এক বাকসো ওয়াটার কালার ও আর্ট পেপার নিয়ে প্রতিযোগিতার দিন উপস্থিত হলাম। অবশ্য হাশেম খানের আঁকা ক্লাস থ্রী-ফোরের বাংলা বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বাসায় অনুশীলন করেছি।

প্রতিযোগিতায় কার্টিজ পেপারে আঁকতে হল। আমার পাশে এক আপুও আঁকতে বসেছেন। আমার ব্যাপার-সেপার দেখে বললেন, আজকে প্রথম এসেছ বুঝি। আমি হ্যা বলতে তিনি অভয় দিলেন। তখন শীতের সময়, বিষয় ছিল খেজুর গাছে রসের হাড়ি এবং গাছীর কর্মকাণ্ড। আপু অন্য গ্রুপের, তাই আমাকে টুবি থ্রিবি পেন্সিল দিয়ে আকার নিয়ম এবং লাইট-শেড দেখালেন। আমি বেশ মজা পেলাম এবং অল্প সময়ের মধ্যে মোটামুটি আঁকাটা ধরতে পারলাম। শেষ পর্যন্ত পেন্সিল স্কেচে শুধু সুবিধা করতে পেরেছি। জল রংয়ে ভুত মার্কা ছবি আঁকলাম। ফলাফল পেন্সিল স্কেচে দ্বিতীয়। তো সেই আপু আমাকে একাডেমির ছবি আঁকার স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। পরের সপ্তাহ থেকে প্রশিক্ষণ ক্লাসে নিয়মিত হলাম। এরপরের প্রতিযোগিতা গুলোয় পুরস্কার একটা না একটা জুটেই যেত। কিন্তু অন্যদিকে হল ভিন্ন রকমের সমস্যা।

ছবি আঁকাটা নেশার মত হয়ে গেল। পড়াশুনার চেয়ে ছবি আঁকা চলছে বেশি। কি করে যেন মুন্নী তা জানতে পেল। শিশু একাডেমিতে মেয়েরা তুলনামূলক বেশি। মুন্নীর এসব পছন্দ না। মাঝে মাঝে রাগ করে কথা বলে না, দেখা দেয় না। কিন্তু আমার আঁকা-আকি তাতে থামে না। আসলে রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার মনের পর্দায় দেখা ছবির পোট্রেট যে আঁকা চলছে, তা কেউ জানে না। আমি আঁকি আর ছবির সাথে কথা বলি। কখনও ছবি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। অভিমান করে আর আমি হাসি।

ক্লাসে স্যার কাপড়ে করা নকশা এঁকে আনতে বললেন। বিশেষকরে কাশ্মীরী শালের নকশার কথা বললেন। আমি কোথায় পাব এ নকশা! হঠাত মনে পড়ল মুন্নীর মায়ের একটা গাঢ় লাল কাশ্মীরী শাল আছে। সুতরাং মান-অভিমান ভাঙ্গিয়ে শাল যোগাড় করার মজাটা টের পেলাম। কারো দিকে নজর করব না এমন শপথ করে শালটা মিলল।

আমার নকশাটা এ্যাওয়ার্ড পেল। খুশিতে চোখ ভিজে গিয়েছিল।

বিকেলে শালটা ফেরত দেয়ার সময় সুখবরের সাথে লাল গোলাপ দিলাম। হায়! মুন্নীও দেখি কাঁদছে। সেই আবির রাঙা মুখে যেন চাঁদের আলোর বান ডেকেছে।

চলবে-

১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
৪র্থ পর্ব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন