মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১২

তাকে নিয়ে প্রথম লেখার যন্ত্রণা!!




স্কুলের বিজ্ঞান ভবনটির সামনে সার বাধা নারকেল আর মেহগনি। তারপরে বিশাল মাঠ। মাঠের ওপাশে শতবছরের রেনট্রি জাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। সেখানে বাদাম আর আচারওলাকে ঘিরে প্রাইমারির ছাত্রীদের জটলা। আমাদের বায়োলজি ও কেমিস্ট্রির প্রাকটিক্যাল কক্ষটি ছিল ভবনের পশ্চিম মাথায় নিচতলায়। ল্যাবরেটরি ও ক্লাস একই সাথে। পশ্চিম দেয়ালে পাঁচটি আলমিরায় যন্ত্রপাতি আর রাসায়নিক দ্রব্য। উত্তর আর দক্ষিণ পাশে পুরো দেয়াল জুড়ে জানালা। পূর্ব পাশে দেয়ালে বিশাল ব্লাকবোর্ড। প্রায় হলরুমের মত বড় এই প্রাকটিক্যাল ক্লাসে আমরা কখনও দুই-তিন ঘন্টা পর্যন্ত মগ্ন থাকতাম।

প্রাকটিক্যাল ক্লাসের দক্ষিণ পাশে বারান্দার পর উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্য বরাবর প্রাইমারি স্কুল। বারান্দার পর ক্লাসটি পঞ্চম শ্রেণীর। প্রায়মারির পূর্বমুখি বারান্দা। মুন্নির মেজো বোন ইভা ফাইভে পড়ে আর ছোট বোন ইলা টুতে। সুতরাং প্রায়ই দুপুরের দিকে মুন্নি সেখানে আসত। আমরা বাদর কমিটি প্রাকটিক্যাল ক্লাসে গান-কবিতা-কৌতুকে জমিয়ে তুলতাম। প্রাইমারির ছাত্র-ছাত্রীরা জানালায় ভীড় করে এসব উপভোগ করত।

তো চিরকুট প্রাপ্তির পর হঠাৎ উপলব্ধি করলাম মুন্নি যেন আমাকে দেখতেই প্রাকটিক্যাল ক্লাসের সামনে আসে। কিন্তু ভাব দেখায় যেন তার বোনের কাছে এসেছে। বিষয়টা অন্যরা খেয়াল করেনি যদিও, কিন্তু আমার কলজে শুকিয়ে যায়। সপ্তাহে তিনদিন প্রাকটিক্যাল ক্লাস এবং দেখলাম সেই তিনদিনই সে এসেছে। এরকম দু'সপ্তাহ খেয়াল করার পর মনে হল প্রাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য আমার ভেতরটাও ছটফট করে। আরে! আমি কি তলিয়ে যাচ্ছি নাকি!

বার বার থু থু ফেলার ছলে বারান্দায় আসি। আমাকে দেখে তার চেহারায় গোলাপী রঙ ধরে। চোখের ভাষা বদলে যায়, তারপর হঠাত অন্যদিকে হাটা শুরু করে। কী করব বুঝতে পারি না। কী করা উচিত তাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।

একদিন রাকিব এসে বলে, তোমার গ্রামারটা একটু দাও ত। আমি কেপে উঠি। বলি, আজকে সাথে নেই। কালকে এসো।

বাসায় ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ি। কিছুই ভাল লাগছে না। চোখ বুজে আকাশ-পাতাল ভাবছি। হঠাৎ কপালে আম্মুর হাত। কি রে এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেন? শরীর খারাপ!

মাকে কিভাবে বুঝাই যে আমি বড়শিতে গেঁথে গেছি। মুখে বলি, না তেমন কিছু না, একটু হয়রান লাগছে। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে আসতে বলে আম্মু রান্না ঘরে ঢোকেন। আসলে আমার খেতেও ইচ্ছে করছে না, অথচ পেটে ইদুর দৌড়াচ্ছে।

বিকেলে মাঠে গেলাম না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে তখন ছবির পর ছবি ভেসে চলেছে। পরীর মত একটি ছোট্ট মেয়ে দৌড়াচ্ছে, হেসে লুটিয়ে পড়ছে, কখনো দৌড়াতে গিয়ে ধপাস করে পড়ছে, হাত ধরে তুলে দিতেই ফিক করে হেসে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কখনও দুম করে পিঠে কিল বসিয়েই দৌড়। কখনও গল্প শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে একটি চাঁদ মুখ।

সেই মুখটি আজ বার বার কেন ভেসে উঠছে মনে। আমি জানি না এটা কি জন্য হচ্ছে। এই অদ্ভুত অনুভূতির সাথে আমি পেরে উঠছি না। আমার শুধু মনে হচ্ছে, আজ একটা কবিতা লিখতে হবে। কিন্তু কি লিখব, কিছুই মনে আসছে না।

পড়ার টেবিলে কবিতার খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখি। ছড়া টাইপ পদ্য। হাবিজাবি নিয়ে লেখা।

কা কা ডাকে কাকের ছা
কাকের মায়ে কই
ক্ষিধের চোটে পরাণ গেল
আনো চিড়ে দই।


কিংবা

উডডুম গুডডুম কী যে বাজে
পান্তা বুড়ির নাতনী সাজে
নাতনী যাবে মেলাতে
পুতুল নাচের খেলাতে।



খাতা বন্ধ করে উঠে পড়ি। সন্ধ্যা নামবে কিছুক্ষণ পর। হাটতে হাটতে মাঠে এসে পড়ি। ক্রিকেট খেলা প্রায় শেষ। মাঠের ওপাশে একটি জানালা শব্দ করে বন্ধ হয়। তাকিয়ে দেখি ধীরে ধীরে আবার খুলছে সেটা এবং সেখানে একটি বিষন্ন মুখ তাকিয়ে আছে এদিকে।

আমি কি করব ভেবে পাইনা। মসজিদে আজান হচ্ছে। বাসার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে আবার জানালায় তাকাই। এবার হাসিতে ঝলমল করে ওঠে সে। তারপর হঠাৎ ভেংচি কেটে জানালা বন্ধ হল।

চলবে-


১ম পর্ব

ছবি-নেট থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন