রবিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১২

নাম তার পরী....




সন্ধ্যাতারা ডুবে গেছে।

চুমকির মত অজস্র তারার ফুল গাঢ় অন্ধকারে চিকমিক করছে। হঠাৎ হঠাৎ দু'একটা আলোর গোলা সাই করে চলে গেল আকাশ চিরে। চাঁদ উঠতে তখনও বেশ বাকি। তারার রাজ্যে আমি কি যেন খুজে চলেছি।

মামাদের অন্দরের উঠোনটা ছোটখাট একটা দাড়িয়াবাধা খেলার মাঠের মত। আর কাচারির ওপাশে আড়ুইবাজি খেলার মত অনেক বড় সদর আঙিনায় কামলারা ধান মাড়াই করছে ছয়টা গরু হাটিয়ে। ধানের মাতাল গন্ধে ডুবে আছে চারদিক।

আমার ভেতরে কে যেন হু হু করে ওঠে। পশ্চিমের বাশঝাড়ে জোনাকির অবিরাম চোখ টিপে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাচ্ছে। খেজুরপাতার পাটিতে শুয়ে আছি। বিশ-পঁচিশ হাত দূরে মামি-নানি আর প্রতিবেশী দু'তিন জন মহিলা খোলা চুলোয় পিঠে বানাচ্ছে।

মাথার তলে ফুল তোলা বালিশ থেকে হালকা একটা সুগন্ধ এসে নাকে লাগছে। বালিশটা মনে হয় পরীর। হঠাৎ খেয়াল হল, নিম তলায় বিছানা দিয়ে পরীটা গেল কোথায়?

এখানে বেড়াতে এসে এবার আমার এই কয়দিনের জীবনটা ভাজা ভাজা করে তুলেছে যে দস্যি মেয়েটা। সে হচ্ছে মামাত বোন পরী। আরো একজন আছে, তবে বাশবাড়িয়া খালের বিশাল বাশের সাকো পার হয়ে সে কদাচিৎ হানা দিয়ে যায়। তালুকদারের ডাকাত মেয়ে আমার সে খালাত বোন রোজির কথা আরেকদিন বলবো। আজ শুধু পরীর কথা বলি।

এখানে আসার পর দেখছি পরীর দিন শুরু হয় ফজরের আজানের পর আমাকে চিমটি দিয়ে, চুল টেনে এবং কখনও ধুমাদ্ধুম কিল বসিয়ে ঘুম থেকে ওঠানো। কারণ এ বাড়িতে ফজরের নামাজ পড়া বাধ্যমূলক।

নানারা তিন ভাই। বিশাল বাড়িতে আলাদা চৌহদ্দি তাদের। তাই কাচারি লাগোয়া পাঞ্জেগানা মসজিদে ফজরের জামাতটা ছেলে-বুড়োয় জমজমাট হয়। জামাত শেষে মসজিদের মকতবে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা সুর করে কুরান পড়ে। ভোরের মুক্ত বাতাসে ভেসে আসা সেই সুর কেমন অপার্থিব আবহ তোলে। পাখিদের কল-কাকলিতে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে চারদিক। গোয়াল ঘরে সদ্য বিয়ানো গরুটা ডাকতে থাকে, কেন তাকে বের করে খড়-পানি দেয়া হচ্ছে না।

পরী মকতব থেকে ফিরে প্রথমেই আমার তত্বতালাশ নেয়। বিছানা গুছাতে গুছাতে নানান প্রশ্ন করে। তার বড়ফুফু কি তার কথা বলে? ফুফুর হাতের খিরসা-পাটি পিঠা তার খুব পছন্দ। এবার ছুটিতে সে খুলনা যাবেই যাবে। ইত্যাদি ধরণের কথাবার্তা। তারপর একবাটি গরম দুধ, খই আর খেজুর গুড় এনে বলে, দাদা খেয়ে নাও। আমার স্কুলের পড়া তৈরি করতে হবে। অংকটা তুমি দেখিয়ে দেবে।

দুই-তিন ঘন্টা পড়া আর গল্প একসাথে চলে। কখনও হঠাৎ উদাস হয়ে জানালা দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে পরী। তারপর কি ভেবে আবার পড়ায় মন দেয়। হুট করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, দাদা! আমি দেখতে খুব পচা তাই না!
আমি অবাক হয়ে বলি, কেনরে! আমার পরির মত বোনটার আজ একথা মনে এল কি করে!

দ্রুত প্রসঙ্গ বদলিয়ে খুলনা বিষয়ক আলোচনা শুরু করে সে।
আচ্ছা, দাদা! ফুফু মাকে বলেছে, তোমার নাকি ছবি আকার বাতিকটা খুব বেড়ে গেছে? তুমি নাকি কোথায় কোথায় ছবি আকা শিখতে যাও? সেখানে কি মেয়েরা ছবি আকা শেখে? পরীর চোখ সরু হয়ে আসে। তার সন্ধানী চোখ আমার ভেতরটা দেখতে থাকে। আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়।

আমি তার ভাব-গতিক বুঝে উঠতে পারি না। পরাজয় এড়াতে বলি, বাদ দে এসব। খুব খিদে পেয়েছে। নাস্তা নিয়ে আয়। পরী মিটমিটে হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে। নাস্তা খেতে খেতে তোমার ছবি আকার গল্পগুলো শুনবো কিন্তু।

চার-পাঁচদিন হল যশোর থেকে মেজোখালা তার তিন মেয়ে নিয়ে এসেছেন। মাশাল্লা! আনিকা, কনা আর চম্পা- তিন বোন যেন এক একটা সাক্ষাত বিচ্ছু! সারাদিন হই-হাঙ্গামা চলে আর তিন বোনের খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাছ বিচারও নেই। কাচা কলা, কাচা পেপে, এমন কি কাচা কদবেলও তারা ছেড়ে দিতে নারাজ। চম্পার আবার দুধের সর খুব পছন্দ। তাই মামির ঘি বানানোর জন্য জমা করে রাখা সর সে হাপিশ করে দিয়েছে। পরী এই ঘটনা বলে আর হাসে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।

এত হাসছিস ক্যান!

আমার প্রশ্ন শুনে সে বলে, ওমা! তুমি জানো না! চম্পার পাতলা নামছে। স্যালাইন বানাইতে বানাইতে মেজো ফুফু হয়রান। চম্পার জন্য ডাক্তার আনতে বাজারে গেছেন আব্বা। কয়েকদিনের বাসি সর খেয়েই তো ওর এই দশা হইছে।

দুপুরের কিছুক্ষণ আগে শুয়ে আছি চোখ বুজে। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে পরী বলল, দাদা, ওঠো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি এক গ্লাস দুধ হাতে দাড়িয়ে আছে সে। বললাম. সকালেই না একবাটি দিলি! এখন আবার!

চুপ! কথা না বলে খেয়ে নাও। আনিকারা শুনলে ঝামেলা হবে।

আমি মুখে দিয়ে বুঝলাম গাঢ় সরও আছে। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন লজ্জা পেল পরী। শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম, তুই কতদিন এভাবে খাওয়াতে পারবি!

যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাড়াল। চলে যাবে এমন সময় হঠাৎ আমার নাকটাকে নির্দয়ভাবে টান দিয়ে চাপা স্বরে বলল, সারা জীবন। তারপর দৌড়ে পালিয়ে গেল।

আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়। তারপর হঠাৎ মনে হল, হায়! এ কোন জালে জড়িয়ে যাচ্ছি আমি!


চলবে-

------------------------------------
আগের পর্বগুলো-
এক
দুই
তিন
চার
পাঁচ
ছয়


ছবি- নেট থেকে মারিং এণ্ড এডিটিং

শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১২

স্বাগত হে ১৪১৯




শুভ নববর্ষ ১৪১৯

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
>
>
>
>
>
মুছে যাক যত গ্লানি ক্লেশ শোক তাপ দুঃখ মনস্তাপ
নব আলোয় দীপ্ত হোক প্রাণ, ক্ষয়ে যাক সব পাপ




নববর্ষের কল্যাণ সবার জীবনে নেমে আসুক। আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ।

বুধবার, ১১ এপ্রিল, ২০১২

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস...........পর্ব তিন




প্রত্যেকটি লেখা, সেটা ধর্মীয় কিংবা সেক্যুলার যাই হোক, পাঠকের কাছে একটি বার্তা নিয়ে আসে। তা হচ্ছে, কে এটা লিখেছে! লেখার বাহ্যিক এবং অন্তরনিহিত আবেদন পাঠককে লেখক সম্পর্কে হৃদয়ে একটি চিত্র দাড় করিয়ে দেয়। একটি লেখা যদি সরাসরি হাতের লেখা হয় আর তাতে শিল্পরস সমৃদ্ধ হয়। পাঠক তাতে আপ্লুত হয়।

আরবি ক্যালিগ্রাফিতে কোন সে আকর্ষণীয় উপাদান রয়েছে যাতে পাঠক মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কুরআনের অবতীর্ণ প্রথম শব্দটি হচ্ছে "পড়!" এর দ্বারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝা যায়। পৃথিবীকে এবং স্বর্গকে পড় চিহ্ন হিসেবে। আপনি প্রথমেই এবং অবশ্যই আগে একজন পাঠক, তারপর বিশ্বাসী।

ক্যালিগ্রাফিকে তাই রেখার আর্ট হিসেবে প্রথমে বিবেচনা করা হয়। আমরা ক্যালিগ্রাফি শব্দটাকে এখানে এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি- এটা এমন একটি শিল্পকলা, যা অত্যন্ত সচেতন, গুরুত্ব দিয়ে নির্দিষ্ট জ্যামিতিক এবং অলংকারিক আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভাষার উপাদানগুলোকে দৃশ্যমান রেখায় তা এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়, যেন হৃদয়ে তা অজান্তে দোলা দিয়ে যায়।

উপরের ছবিটি আরবি শব্দ "কালিমা"। এর অর্থ- শব্দ। ১৪-১৫ শতকে এ ধরণের লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। এখানে যেটা আছে, তা অবশ্য আমার নিজের হাতে লেখা। একে 'ফুলেল কুফি' বলে। হরফের প্রান্তগুলো লতা-পাতা এবং ফুল শোভিত করার যে প্রচেষ্টা দেখা যায়। এতে সুক্ষ্মভাবে শিল্পকলার রীতিগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এতে খাগ বা কঞ্চির কলম আর কালি দিয়ে শুধু রেখার যে গতিপ্রকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তুলির ব্যবহারে তা সম্ভব নয়।

নান্দনিকতা বলে শিল্পকলায় যে বিষয় রয়েছে। সেখানে পটভূমির প্রেক্ষিতে মূল বিষয়কে আকর্ষণীয় করে স্থাপন করাটাই সার কথা।

বাঙলা ক্যালিগ্রাফিতে সেই কাজটি এখনও আমরা সেভাবে করে উঠতে পারিনি।




 ----------------------------------------------------------
আগের পোস্ট

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস............পর্ব এক

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস...........পর্ব দুই

 

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস...........পর্ব দুই





আমরা ক্যালিগ্রাফির বিষয় জানতে গিয়ে দেখি হরফ বা অক্ষরকে শিল্প এবং একটা নীতিমালার সংমিশ্রনে গড়ে তোলা হয়েছে। আরবি কিংবা বাঙলা যে ভাষাই হোক না কেন, হরফের কাঠামোকে শিল্প সম্মত করে প্রকাশের প্রচেষ্টা করেছেন শিল্পীরা।

বাঙলা হরফের বিষয়ে বর্তমান কম্পিউটারে যে সুতন্বি ফন্ট দেখছি, তার নাম ছিল তন্বি। '৮০ দশকে প্রথমে বাংলাদেশে কিভাবে মোস্তফা জব্বার এটা করলেন, সে বিষয়টা নিয়ে একটু বলি। মোস্তফা জব্বার নিজে আর্টিস্ট নন এবং হাতে-কলমে এটা করার সুযোগ তার ছিল না। বাঙলা হরফ তৈরির জন্য তিনি শিল্পী হামিদুল ইসলামকে(চারুকলার শিল্পী হামিদ ভাই না) সাথে নিয়ে কাজ শুরু করেন। হামিদুল ইসলামের বাঙলা হাতের লেখা চমৎকার এবং বাঙলা হরফ নিয়ে তিনি কাজ করেন।

যখন এটা করা হয়েছিল তখন ইনপুট ব্যবস্থা এখনকার মত ভাল ছিল না। হামিদুল ইসলাম বাঙলা হরফের লেআউট করে দিতেন। সেটা দেখে স্ক্রিনে অনুমান করে পাথ (ফটোশপে পেন টুল দিয়ে রেখার মাধ্যমে অক্ষরের আউটলাইন দেয়া) করে প্রিন্ট করে আবার সেটা ঠিক করা হত। এতে হরফের আকৃতি শিল্পীর মনমত এবং শিল্পসম্মত করা খুবই কঠিন ছিল। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে এটা করা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হামিদুল একটি উপায় বের করেন। মজার বিষয় হচ্ছে ইনপুট জিনিসটা কি, মোস্তফা জব্বার সেটা তখন জানতেন না। আর স্ক্যান করার যন্ত্রও তাদের ছিল না।

উপায়টি হল- হামিদুল একটি সেলোফেন পেপারে মনিটরের মাপ মত হরফ লিখতেন। এরপর সেটা মনিটরের ওপর কসটেপ দিয়ে সেটে দিয়ে পাথ করা হত। এতে হরফের আকৃতিতে যথার্থ রূপটি এসে যায়। এভাবে তন্বি ফন্ট হয়।

হামিদুল এটার আদর্শ হিসেবে রোমান হরফের (রেগুলার) মাপকে গ্রহণ করেন। হরফের ভেতর মাপ ও চোখে ভাল লাগার জন্য বিভিন্ন কারিগরি বিষয় আছে, যেটা বেশ জটিল। বর্তমানে হরফকে একটি নীতিমালার ভেতর ফেলে গঠন করা হয়।



কিন্তু বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফিক বাঙলা অক্ষর এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে চেষ্টা চলছে।



আরবি হরফে প্রথম দিকে যে কুরআন লেখা হয়েছিল। সে লিপির নাম কুফি। তৃতীয় খলিফা ওসমান বিন আফফানের হাতে লেখা কুরআনের একটি পাতা দেখেন।



আর বর্তমানে সৌদি আরবের কুরআন কমপ্লেক্সের প্রধান ক্যালিগ্রাফার ওসমান তাহা'র হাতে লেখা কুরআনের পাতা। এটি নাশখ(কপি করা) লিপিতে লেখা।



কিন্তু ক্যালিগ্রাফির এখন প্রাধান লিপি হচ্ছে সুলুস(এক তৃতীয়াংশ)। এর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য অসাধারণ।



এলিপির স্বতন্ত্র হরফ কেমন, সেটা দেখেন।



আরবি হরফ ২৮টি। কিন্তু মুল কাঠামো ১৮টি। আর প্রাথমিক হরফ ৩টি। আলিফ, বা এবং নুন থেকে বাকী হরফের আকৃতি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া নোকতা বা ডট ব্যবহার করে হরফ বাড়ানো হয়েছে। এখানে নোকতা বাড়িয়ে হরফ আলাদা করার একটি ছবি দেখেন।



আরবিতে একটি হরফ শব্দের প্রথমে, মধ্যে এবং শেষে বসলে চেহারা পাল্টে যায়। এখানে ফা হরফটির রূপান্তর কেমন হয় দেখা যাক।



সুলুস লিপির একটি ক্যালিগ্রাফি



আরবি হরফ বিভিন্ন ভাষার লিপি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষা লেখা হয়ে থাকে লাতিন হরফে। এরপরেই আরবি হরফের স্থান। ফারসী, ওসমানীয় তুর্কি, উর্দু, মালে, দারি, কুরদিস, পস্তু, বালুচী, কাশ্মীরী, সিন্ধী, ইথোপিয় প্রভৃতি ভাষা আরবি হরফে লেখা হয়ে থাকে।

আরবি হরফকে এত সুন্দর এবং দৃষ্টি নন্দন দেখানোর রহস্য হচ্ছে- এর বাহ্যিক গঠনে নমনীয়তা এবং চর্বিহীন ধারাল শরীর, আর সচল ভঙ্গী। হরফ দেখলে মনে হয়, এটি চলছে। এই গতিশীলতা দৃষ্টিকে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর তাল-লয়-ছন্দকে এতে খুব সচেতনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া অলঙ্কারের ব্যবহার একে আরো রূপবতী করে তুলেছে।



চলবে-

ছবি- নেট থেকে।


----------------------------------------------------------
আগের পোস্ট

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস............পর্ব এক

শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১২

কুফি কুরআন


দার কুতুব আল দোহা, কাতারে সংরক্ষিত ওসমানিয় কুরআনের একটি পাতা, কুফি লিপিতে লেখা।সুরা আনআমের একটি পাতা।






কুফি মায়েল-এ লেখা কুরআনের একটি পাতা। এটি ৮ম শতাব্দির দ্বিতীয় ভাগে লেখা। সুরা নুরের একটি পাতা।



লিপিটির নাম-বাহরি লিপি(সাগর লিপি)।
এর অন্য নাম বিহারি লিপি(ভারতের বিহারে ১৪ শতকে এলিপিতে প্রচুর কুরআন কপি হত)।

বুধবার, ৪ এপ্রিল, ২০১২

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন যিনি....




একজন আর্টিস্ট যখন দৃষ্টিপাত করেন, হৃদয়ের জানালা দিয়ে তখন বহুদূর তিনি দেখতে পান। শিল্পী মনের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন শিল্প সুষমা। সৃষ্টির শুভ্র নিটোল আর দীপ্ত আকাশ যেন প্রতিভাত হয় তুলির নিপুন আচড়ে।



বাংলাদেশের একজন নিভৃতচারী শিল্পী সাইফুল ইসলাম। তিনি একান্ত আড়ালে তার শিল্প সাধনা করে চলেছেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হৃদয়ের মনিকোঠায় প্রগাঢ় ভালবাসায় জড়িয়েছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর অনেক পোর্ট্রটসহ লাইফ সাইজ প্রতিকৃতিও এঁকেছেন।

লালনের কুষ্টিয়ায় এই প্রতিভাবান লিজেন্ড শিল্পীর জন্ম ১৯৪৬ সালে। ছোটবেলায় প্রজাপতির ওড়াউড়ি, কাশবনের মাতাল হাওয়া তাকে মগ্নতায় আবিষ্ট করে তোলে। ছবি আঁকার মাঝে তিনি প্রকৃতির সুর খুজতে প্রয়াস পান। মানবের মুখাবয়ব তাকে কৌতুহলী করে তোলে। ধীরে ধীরে তিনি পোর্ট্রেট আঁকায় সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন।

১৯৬৯ রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়ে এম কম পড়ছিলেন। কিন্তু ছবি আঁকার অদম্য ইচ্ছাটাই তাকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করে। বছরখানেক চাকুরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু মন মানেনা। চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন।

তার জীবনে অনুপ্রেরণা আর বড় ধরণের পরিবর্তন আসে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে। একবছরের মধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি অঙ্কন করেন।



১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় একটি রিপোর্ট ছাপা হয়-


বঙ্গবন্ধু সকাশে শিল্পী সাইফুল ইসলাম

কুষ্টিয়ার প্রতিভাবান শিল্পী জনাব সাইফুল ইসলাম গত শনিবার এক ঘরোয়া পরিবেশে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে শিল্পীর নিজের হাতে আঁকা বঙ্গবন্ধুর এই তৈল চিত্রটি উপহার দেন। ছবিটি আঁকতে শিল্পীর ১৫ দিন সময় লাগে।

জনাব সাইফুল ইসলাম গত ১৯৬৭ সালে কুষ্টিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় বসবাস করছেন। যে কোন মানুষের তৈল চিত্র অঙ্কনে শিল্পীর একটি স্বকীয় ভঙ্গী আছে।


বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এই মহান শিল্পী সারা জীবন ধরে শিল্প চর্চা করেছেন। তিনি বাংলার নিসর্গ এঁকেছেন নিজস্ব রীতিতে। চিরায়ত বাংলার রূপ সৌন্দর্য তার দক্ষ হাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি শিল্পের টানে রাশিয়া সফর করেছেন। পরে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি।

তার বিশেষ আগ্রহ ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে। তার অসংখ্য ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম দেশে বিদেশে সংগৃহীত হয়েছে। বিশেষ করে বাংলা ক্যালিগ্রাফিকে তিনি নতুন মাত্রা দিয়েছেন। এছাড়া স্টিল লাইফ, ল্যান্ডস্কেপ আর পোর্ট্রেট আঁকায় তার সুখ্যাতি রয়েছে।

এই শিল্পীর বিশাল শিল্পকর্মের ভাণ্ডার সংরক্ষন করা প্রয়োজন।



_______________________________________________________
শিল্পীর কাজগুলো নিয়ে আলাদা লেখার ইচ্ছে আছে।

রবিবার, ১ এপ্রিল, ২০১২

ক্যালিগ্রাফির ক্লাস.....পর্ব এক





ক্যালিগ্রাফির বিষয়ে আগ্রহ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। পৃথিবীতে সভ্যতার বাহন হচ্ছে লিপি। এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতার সংযোগ, সম্পর্ক, জ্ঞান ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন লিপির প্রধান কাজ।

পৃথিবীতে দৃশ্যমান শিল্পকলার আদি উৎস লিপি। আর লিপিকে শিল্পে রূপ দানের ভেতর লুকিয়ে আছে সভ্যতার ঐতিহ্যকথা।

বিভিন্ন ভাষার ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। তবে রূপ-মাধুর্য্যে আরবি ক্যালিগ্রাফির তুলনা মেলা ভার!

প্রশ্ন হল- আরবি ক্যালিগ্রাফি জিনিসটা কি?


আরবি ক্যালিগ্রাফির একটি নমুনা।

আরবি ক্যালিগ্রাফির পরিচয় এভাবে দেয়া যেতে পারে- আরবি হরফ বা টেকসট ব্যবহার করে চমৎকার লেখন শিল্পকে আরবি ক্যালিগ্রাফি বলে।

আরেকটা কথা, ক্যালিগ্রাফি শব্দটা ইংরেজি। এটা গ্রীক শব্দ ক্যালিগ্রাফিয়া থেকে এসেছে। গ্রীক শব্দ ক্যালোস এবং গ্রাফেইনের মিলিত রূপ ক্যালিগ্রাফিয়া। ক্যালোস=সুন্দর, আর গ্রাফেইন=লেখা।

ক্যালিগ্রাফিকে আরবিতে বলে খত আল আরাবি। তুর্কিতে বলে হাত। আর ফারসিতে খোশ নবিসী।

আরবি ক্যালিগ্রাফিকে আবার ইসলামী ক্যালিগ্রাফিও বলে। কারণ, এটা প্রথম মার্জিত ও উন্নত হয় ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন লিপিবদ্ধ ও অনুলিপি করার মাধ্যমে। ইসলামী বিশ্বে একে দৃশ্যমান শিল্পকলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাবান উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে, এই আর্ট ফর্মকে বিভিন্ন দেশ, ভাষা এবং ধর্মের লোকেরা আনন্দচিত্তে গ্রহণ এবং চর্চা করে চলেছেন।


"Islam has exerted also a more subtle, a more indirect influence on the development of calligraphy: by discouraging the graphic representation of human beings and animals it channeled the creative energies of Muslim artists toward other decorative arts, especially calligraphy."

From: Al-Baba, Kamel. "Calligraphy: A Noble Art." Saudi Aramco World, 15:4: 1-7. July/August 1964.



আরবি স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফি কি?

আরবি স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফির একটি নমুনাচিত্র

বইপত্র, নথি, ফরমান, মানপত্র ইত্যাদি কাগজের ওপর আরবি হরফে যে ক্যালিগ্রাফি করা হয়, সেটাই আরবি স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফি।

এবার প্রশ্ন হতে পারে, ক্যালিগ্রাফি আর হ্যাণ্ড রাইটিং বা হাতের লেখার ভেতর কি পার্থক্য আছে?

ক্যালিগ্রাফি হ্যাণ্ড রাইটিং থেকে আলাদা এজন্য যে, ক্যালিগ্রাফি একই সাথে শিল্পতৃষ্ণা এবং আটপৌরে জীবনের প্রয়োজন মেটায়।

অন্যদিকে, হ্যাণ্ড রাইটিং হচ্ছে যোগাযোগ বা শুধু প্রয়োজনকে তুলে ধরে। নন্দন বা সৌন্দর্য সেখানে গৌণ।


হাতে লেখা একটি অভিধানের পাতা

ক্যালিগ্রাফি চর্চাকরা হয় এর ভেতরের সৌন্দর্য এবং অন্তরনিহীত শিল্পকে তুলে ধরতে।

ক্যালিগ্রাফি এবং হ্যাণ্ড রাইটিংয়ের মধ্যে আরেকটা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, উপায় উপকরণের ভিন্নতা। ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি কলম ব্যবহার করা হয়। আর সাধারণ লেখায় যে কোন কলম হলেই চলে।


আরবি ক্যালিগ্রাফি করার কলম

ক্যালিগ্রাফি কলমকে 'কলম খাশাব' এবং 'কলম বুস' বলে।

ক্যালিগ্রাফি করার জন্য বিশেষ কিছু নিয়ম এবং পদ্ধতি মেনে চলতে হয়। যেমন একটি লিপিতে অলঙ্কার ব্যবহার হয় আবার দেখা যায় আরেকটি লিপিতে তা নিষিদ্ধ এবং আকার-আকৃতি একেক লিপির একেক রকম।

ক্যালিগ্রাফির লিপির মধ্যে এই বৈচিত্র এসেছে সংস্কৃতি, ধর্ম এবং শিল্পবোধের প্রাত্যাহিক চর্চার মাধ্যমে।


চলবে-

ছবি-নেট থেকে