রবিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১২

নাম তার পরী....




সন্ধ্যাতারা ডুবে গেছে।

চুমকির মত অজস্র তারার ফুল গাঢ় অন্ধকারে চিকমিক করছে। হঠাৎ হঠাৎ দু'একটা আলোর গোলা সাই করে চলে গেল আকাশ চিরে। চাঁদ উঠতে তখনও বেশ বাকি। তারার রাজ্যে আমি কি যেন খুজে চলেছি।

মামাদের অন্দরের উঠোনটা ছোটখাট একটা দাড়িয়াবাধা খেলার মাঠের মত। আর কাচারির ওপাশে আড়ুইবাজি খেলার মত অনেক বড় সদর আঙিনায় কামলারা ধান মাড়াই করছে ছয়টা গরু হাটিয়ে। ধানের মাতাল গন্ধে ডুবে আছে চারদিক।

আমার ভেতরে কে যেন হু হু করে ওঠে। পশ্চিমের বাশঝাড়ে জোনাকির অবিরাম চোখ টিপে যাওয়া দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যাচ্ছে। খেজুরপাতার পাটিতে শুয়ে আছি। বিশ-পঁচিশ হাত দূরে মামি-নানি আর প্রতিবেশী দু'তিন জন মহিলা খোলা চুলোয় পিঠে বানাচ্ছে।

মাথার তলে ফুল তোলা বালিশ থেকে হালকা একটা সুগন্ধ এসে নাকে লাগছে। বালিশটা মনে হয় পরীর। হঠাৎ খেয়াল হল, নিম তলায় বিছানা দিয়ে পরীটা গেল কোথায়?

এখানে বেড়াতে এসে এবার আমার এই কয়দিনের জীবনটা ভাজা ভাজা করে তুলেছে যে দস্যি মেয়েটা। সে হচ্ছে মামাত বোন পরী। আরো একজন আছে, তবে বাশবাড়িয়া খালের বিশাল বাশের সাকো পার হয়ে সে কদাচিৎ হানা দিয়ে যায়। তালুকদারের ডাকাত মেয়ে আমার সে খালাত বোন রোজির কথা আরেকদিন বলবো। আজ শুধু পরীর কথা বলি।

এখানে আসার পর দেখছি পরীর দিন শুরু হয় ফজরের আজানের পর আমাকে চিমটি দিয়ে, চুল টেনে এবং কখনও ধুমাদ্ধুম কিল বসিয়ে ঘুম থেকে ওঠানো। কারণ এ বাড়িতে ফজরের নামাজ পড়া বাধ্যমূলক।

নানারা তিন ভাই। বিশাল বাড়িতে আলাদা চৌহদ্দি তাদের। তাই কাচারি লাগোয়া পাঞ্জেগানা মসজিদে ফজরের জামাতটা ছেলে-বুড়োয় জমজমাট হয়। জামাত শেষে মসজিদের মকতবে পাড়ার ছেলে-মেয়েরা সুর করে কুরান পড়ে। ভোরের মুক্ত বাতাসে ভেসে আসা সেই সুর কেমন অপার্থিব আবহ তোলে। পাখিদের কল-কাকলিতে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে চারদিক। গোয়াল ঘরে সদ্য বিয়ানো গরুটা ডাকতে থাকে, কেন তাকে বের করে খড়-পানি দেয়া হচ্ছে না।

পরী মকতব থেকে ফিরে প্রথমেই আমার তত্বতালাশ নেয়। বিছানা গুছাতে গুছাতে নানান প্রশ্ন করে। তার বড়ফুফু কি তার কথা বলে? ফুফুর হাতের খিরসা-পাটি পিঠা তার খুব পছন্দ। এবার ছুটিতে সে খুলনা যাবেই যাবে। ইত্যাদি ধরণের কথাবার্তা। তারপর একবাটি গরম দুধ, খই আর খেজুর গুড় এনে বলে, দাদা খেয়ে নাও। আমার স্কুলের পড়া তৈরি করতে হবে। অংকটা তুমি দেখিয়ে দেবে।

দুই-তিন ঘন্টা পড়া আর গল্প একসাথে চলে। কখনও হঠাৎ উদাস হয়ে জানালা দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে পরী। তারপর কি ভেবে আবার পড়ায় মন দেয়। হুট করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, দাদা! আমি দেখতে খুব পচা তাই না!
আমি অবাক হয়ে বলি, কেনরে! আমার পরির মত বোনটার আজ একথা মনে এল কি করে!

দ্রুত প্রসঙ্গ বদলিয়ে খুলনা বিষয়ক আলোচনা শুরু করে সে।
আচ্ছা, দাদা! ফুফু মাকে বলেছে, তোমার নাকি ছবি আকার বাতিকটা খুব বেড়ে গেছে? তুমি নাকি কোথায় কোথায় ছবি আকা শিখতে যাও? সেখানে কি মেয়েরা ছবি আকা শেখে? পরীর চোখ সরু হয়ে আসে। তার সন্ধানী চোখ আমার ভেতরটা দেখতে থাকে। আমার অস্বস্তি বেড়ে যায়।

আমি তার ভাব-গতিক বুঝে উঠতে পারি না। পরাজয় এড়াতে বলি, বাদ দে এসব। খুব খিদে পেয়েছে। নাস্তা নিয়ে আয়। পরী মিটমিটে হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে। নাস্তা খেতে খেতে তোমার ছবি আকার গল্পগুলো শুনবো কিন্তু।

চার-পাঁচদিন হল যশোর থেকে মেজোখালা তার তিন মেয়ে নিয়ে এসেছেন। মাশাল্লা! আনিকা, কনা আর চম্পা- তিন বোন যেন এক একটা সাক্ষাত বিচ্ছু! সারাদিন হই-হাঙ্গামা চলে আর তিন বোনের খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাছ বিচারও নেই। কাচা কলা, কাচা পেপে, এমন কি কাচা কদবেলও তারা ছেড়ে দিতে নারাজ। চম্পার আবার দুধের সর খুব পছন্দ। তাই মামির ঘি বানানোর জন্য জমা করে রাখা সর সে হাপিশ করে দিয়েছে। পরী এই ঘটনা বলে আর হাসে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।

এত হাসছিস ক্যান!

আমার প্রশ্ন শুনে সে বলে, ওমা! তুমি জানো না! চম্পার পাতলা নামছে। স্যালাইন বানাইতে বানাইতে মেজো ফুফু হয়রান। চম্পার জন্য ডাক্তার আনতে বাজারে গেছেন আব্বা। কয়েকদিনের বাসি সর খেয়েই তো ওর এই দশা হইছে।

দুপুরের কিছুক্ষণ আগে শুয়ে আছি চোখ বুজে। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে পরী বলল, দাদা, ওঠো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি এক গ্লাস দুধ হাতে দাড়িয়ে আছে সে। বললাম. সকালেই না একবাটি দিলি! এখন আবার!

চুপ! কথা না বলে খেয়ে নাও। আনিকারা শুনলে ঝামেলা হবে।

আমি মুখে দিয়ে বুঝলাম গাঢ় সরও আছে। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন লজ্জা পেল পরী। শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম, তুই কতদিন এভাবে খাওয়াতে পারবি!

যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘুরে দাড়াল। চলে যাবে এমন সময় হঠাৎ আমার নাকটাকে নির্দয়ভাবে টান দিয়ে চাপা স্বরে বলল, সারা জীবন। তারপর দৌড়ে পালিয়ে গেল।

আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ়। তারপর হঠাৎ মনে হল, হায়! এ কোন জালে জড়িয়ে যাচ্ছি আমি!


চলবে-

------------------------------------
আগের পর্বগুলো-
এক
দুই
তিন
চার
পাঁচ
ছয়


ছবি- নেট থেকে মারিং এণ্ড এডিটিং

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন