শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বঙাল এবং বঙ্গ বিষয়ক ভাবনা

বাঙলা শব্দটি প্রথম কোন প্রাচীন সূত্র থেকে এল, সেটা নিয়ে খোজাখুজি করছিলাম। নেটে তেমন কিছু পাওয়া গেল না।

বইপত্র ঘেটে কিছুটা চিন্তা-ভাবনার খোরাক পাওয়া গেল।

বাঙলা ভাষা, বাঙলা দেশ, বাঙালী।
এই তিনটি বিষয় নিয়ে একটু প্রাচীন সূত্র ঘেটে দেখা দরকার।

প্রাচীনকালে বাঙালা ভূখন্ড বলে যাকে চিহ্নিত করা হত, তার নাম ছিল বঙ্গাল, বঙাল বা বাঙালা।

চর্যাপদের কবি ভুসুকুপাদানাম-এর কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়-

বাজ নাব পাড়ী পউআঁ খালে বাহিউ।
অদঅ বঙাল দেশ লুড়িউ।।


ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চর্যাপদে মীননাথ ভণিতায় প্রাপ্ত পদটি ধরে বলেছেন মীননাথের সময়কাল সপ্তম শতক।
কারণ মীননাথ এবং মৎস্যেন্দ্রনাথ একই ব্যক্তি এটা ইতিহাসে প্রমানীত হয়েছে।

অন্যদিকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষা বৈশিষ্ট্য হতে চর্যাপদের ভাষা দেড়শত বছরের পুরাতন। তিনি চর্যাপদের রচনাকাল ৯৫০ হতে ১২০০ সালের মধ্যে নির্দিষ্ট করেছেন।

যাই হোক বঙাল দেশ বলে একটা দেশ ছিল, তা আমরা চর্যাপদের ২৪ কবির এক কবি ভুসুকুপাদাম-এর কবিতায় খুজে পেলাম।

চর্যাপদের কবিদের জন্মভূমি কোথায় ছিল? কবিতাটা খেয়াল করলেই জবাব পাওয়া যায়, বঙাল দেশ ছিল তাদের মাতৃভূমি।

এবার একটু ভিন্ন কথা নিয়ে আলোচনা করি, স্বাধীনতা-উত্তরকালে ডাক টিকেট বাংলা দেশ শব্দটা বাংলা এবং দেশ আলাদা করে লেখা ছিল। অর্থাৎ বাংলা নামে একটি প্রাচীন ভূখন্ড ছিল, যাকে বাঙলা, বাঙ্গালাহ, বঙাল বলে ১৮ শতক পর্যন্ত ঙ দিয়ে লেখা হয়েছে। কবি রবীন্দ্রনাথই প্রথম গানে ধ্বনিঘাত ঠিক রাখতে বাংলা লিখেন। ঙ অক্ষরে ং+গ ধ্বনি সংযুক্ত।



বাংলা শব্দ দিয়ে কখনো বাঙালী বা বাঙ্গালী শব্দ লেখা সম্ভব নয়।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন- "..অনুস্বারের ধ্বনি বাঙ্গালা ভাষায় "ঙ"-এর উচ্চারণের সহিত অভিন্ন হইয়া দাঁড়ানোর ফলে, "বাঙ্লা" শব্দকে "বাংলা" রূপে লেখা হয়। কিন্তু "বাঙাল-বাঙালী" এই শব্দ-দ্বয়ে অনুস্বার লেখা অসম্ভব।... এতদ্ভিন্ন, সংস্কৃতে অনুস্বারের যে উচ্চারণ ছিল... তাহার বিচার করিলে অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" শব্দের সংস্কৃত মতে উচ্চারণ দাঁড়ায় "বাআঁলা"; উত্তর-ভারতে এখন অনুস্বার-যুক্ত "বাংলা" উচ্চারিত হইবে "বান্ লা" রূপে, দক্ষিণ-ভারতে "বাম্ লা" রূপে। এই সমস্ত কারণে, "ঙ"-দিয়া "বাঙ্লা" লেখাই যুক্তিযুক্ত।"

ড. হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফসহ ঢাবির বাঙলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান বাঙালী আদি শব্দের ব্যবহার ঠিক রেখে বাঙলা শব্দ লেখাকে ঙ দিয়ে লেখা শুদ্ধ বলেছেন।

ড. হুমায়ুন আজাদের বইয়ের প্রচ্ছদ-



আহমদ শরীফের বইয়ের প্রচ্ছদ-




প্রাচীন আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে আবুল ফজল লিখেছিলেন, বঙাল(بنغال) ভূখণ্ডের কখা। (بنغال) এ শব্দটি এসেছে বং(بنغ) বা (بانغ) থেকে। আর (ال) অর্থ বংশ। অর্থাৎ (بنغ+ال) বঙ এর বংশ।


ملك البنغال মুলুকে বাঙাল শব্দ ব্যবহার হয়েছে বাঙলা ভূখণ্ডে বুলবন সুলতানদের শাসনকালে(১২৮২-১৩৩৯ খৃ.)। মুলুক অর্থ রাজ্য, দেশ।

بلاد البنغال বিলাদ বাঙাল শব্দ ব্যবহার করেছেন ইলিয়াস শাহী সুলতানগণ(১৩৩৯-১৪১৪ খৃ.)। বিলাদ অর্থ দেশ। তবে এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে স্বাধীন দেশ।



صوبه بنغال সুবে-বাঙলা শব্দটি মোগল শাসকরা ব্যবহার করেন। সুবাহ অর্থ- প্রদেশ।


এই বাঙলা ভূখন্ডের অধিবাসীদের সব সময়ই বঙাল বা বাঙাল বলা হত। এখনও বলা হয়।



এবার বঙ্গ শব্দটি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এটি নদিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের সাথে সংশ্লিষ্ট। বঙ্গ শব্দটি বাঙালের সাথে যুক্ত হয়ে মুলুকে বাঙলা হয় সুলতানদের মাধ্যমে।

প্রাচীন বঙ্গ আর্য শাসকদের করতলগত হয়ে গৌড় হয়। ১৩৫১ সালে গৌড় এবং বঙাল মিলে হয় বাঙালা বা বাঙ্গালাহ। ১৯০৫ সালে এটা ভেঙ্গে দু'টুকরা করা হয়. একে বঙ্গভঙ্গ বলা হয়। ১৯১১ সালে আবার তা রদ হয়। ১৯৪৭ সালে আবার দুটুকরা হয়। আর ১৯৭১ সালে ৪৭ এর অংশ হয় স্বাধীন বাঙলা দেশ(বাংলা দেশ>বাংলাদেশ)।

বাংলার দু'টুকরার একটা পশ্চিম আর একটা পূর্ব। পশ্চিম বাংলা প্রাচীনকালে বঙ্গ, এরপর গৌড়, তারপর বাঙ্গালাহ বা বাঙালা, এরপর পশ্চিম বাংলা থেকে এখন আবার পশ্চিমবঙ্গ হয়েছে।

এই হচ্ছে ব্যাপার। বঙ্গ এবং বঙাল একদেশ একভাষা একজাতি হিসেবে ১৩৫১-১৯০৫ পর্যন্ত ছিল। এর আগে এটাকে একত্রিত হিসেবে পাওয়া যায় না আর এখন ত এটা আলাদাই চলছে।

সুতরাং বঙাল আর ঘটি(গৌড়ের অধিবাসী) নিয়ে আমাদের আরো গবেষণা হতে পারে।

ছবি- নেট থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন