শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

হোসেনী দালানে দৃষ্টিনন্দন ক্যালিগ্রাফি


রাজধানী ঢাকার গোড়াপত্তন ১৬০৮ খৃস্টাব্দে সুবাদার ইসলাম খানের হাতে। এই ঢাকায় দু'বছর সম্রাট জাহাঙ্গীর কাটিয়ে গেছেন। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা ঢাকায় থেকে দীর্ঘকাল সুবাদারি করেছেন বাঙলার। ঢাকার ঐতিহ্য পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে।

পুরান ঢাকার নিমতলীর পাশে একটি প্রাচীন স্থাপনা হোসেনী দালান (হুসাইনী দালান, ইমামবাড়া)। শাহ সুজার নিজামতের নেওয়াড়ের দারোগা মীর মুরাদ ১০৫২ হিজরি মোতাবেক ১৬৪২ খৃস্টাব্দে এই ইমারতটি নির্মাণ করেন।


প্রসিদ্ধি আছে যে, মীর মুরাদ এক রাতে স্বপ্নে দেখেন হযরত ইমাম হুসাইন রা. একটি ইমামবাড়া(শোকাগার) তৈরি করেছেন এবং তিনি মীর মুরাদকেও নির্দেশ দেন যেন তাঁর স্মৃতিরূপে একটি ইমামবাড়া তৈরি করা হয়। এ স্বপ্ন দেখার পরের দিন মীর মুরাদ এ ইমামবাড়া নির্মাণ শুরু করেন এবং সদিচ্ছা নিয়ে তিনি এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন।

এটি একটি অত্যন্ত মনোরম দ্বিতল ভবন। এতে দুটি মিনার, দক্ষিণ দিকে বারান্দার নিচে একটি প্রশস্ত জলাশয়, উত্তর দিকে একটি প্রশস্ত মাঠের পর দেউড়ি(ছাদযুক্ত প্রধান তোরণ) এবং দ্বিতল নহবতখানা, পশ্চিমে তাজিয়া প্রভৃতির ঘর। এর সাথে একটি দ্বিতল আলাদা ঘরে পুলিশের সেকশান। চারদিকে ঘেরার দেয়ালএবং দক্ষিণ দিকেও একটি দেউড়ি।


১৯০৪ সালে হোসেনী দালানের দক্ষিণ ভিউ

মহররম মাসে এসব দেয়ালের তাকের ওপর প্রদীপ দিয়ে আলো জ্বালানো হয় এবং দালানের ওপর মেহরাব ও মিনারের ওপর আয়নার ঢাকনা লাগিয়ে আলো জ্বালানো হয়। এতে দালানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং দেখতেও সুন্দর লাগে। মীর মুরাদের পর ঢাকার নায়েব-ই নাযিমগণ এ ইমামবাড়ার মুতাওয়াল্লী থাকেন। তারা এর ব্যয় বাবদ নিজামত(সরকারি কোষাগার) থেকে বছরে আড়াই হাজার টাকা খরচ বরাদ্দ করেন। যা আজকাল সরকার থেকে পাওয়া যায়। ব্যবস্থাপনার জন্য একজন দারোগা নিযুক্ত থাকেন এবং অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুরূপে কাজকর্ম সমাধা হয়।

১৮৯৭ খৃস্টাব্দের ভূমিকম্পে এ বাড়ির অধিকাংশ ভেঙ্গে পড়ে গেলে ঢাকার নওয়াব স্যার আহসান উল্লাহ বাহাদুর আনুমানিক এখলাখ টাকা ব্যয়ে তা নতুনভাবে নির্মাণ ও মেরামত করে দেন।

হুসাইনী দালানের শিলালিপির অবিকল বর্ণনা নিম্নরূপ:
" দর জমানে পাদশাহ ব ওকর----ইন আজিমশ শানে শাহ ন মদার
সাখতে আয়ে ম ছেওয়া সাইয়েদ মুরাদ----দরসনে পানজ অ দর ছার একে হাজার সানাত হিজরি ১০৫২"

ফারসী থেকে অনুবাদ- ওই মর্যাদাবান পরাক্রান্ত ও প্রসিদ্ধ বাদশাহের আমলে সৈয়দ মুরাদ এক হাজার বায়ান্ন সালে এই শোকাগারটি নির্মাণ করেন।১০৫২ হিজরি।


১৯১০ সালে মারা যাবার আগে মুনশী রহমান আলী তায়েশ তার রচিত জীবনের শেষ প্রামান্য গ্রন্থ 'তাওয়ারিখে ঢাকা'য় হোসেনি দালান সম্পর্কে এ বর্ণনা লিখে গেছেন।

এরপর নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে আশির দশকে এর অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে পড়ে। ১৯৯৫ সালে মেয়র হানিফের সময়ে পুকুরসহ এর ব্যাপক সংস্কার হয়। ২০১০ সালে এসে এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ ব্যাপকভাবে করা হয়। হোসেনি দালানে ভেতরের ও বাইরের অঙ্গসজ্জা ও সংস্কারে ফুটে উঠেছে ইরানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাশৈলী রূপ। সৌন্দর্যবর্ধনের এ কাজ করেছে ঢাকার ইরানি দূতাবাস। জানা যায়, ইরান সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় এতে ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা অংশ নেন। সাত মাস ধরে এ কাজ চলে।


দালানের অভ্যন্তরভাগ

সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কারকাজের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশেষকরে আরবি ক্যালিগ্রাফি কুরআনের আয়াত,সুরা, রাসুল, আহলে বায়তের নাম ইরানি সুলুস লিপিতে করা হয়েছে।


ক্যালিগ্রাফি করছেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম

মূল ইমারতের ভেতরে ছাদের চারপাশে কাচের নকশা লাগানো হয়েছিল কিন্তু তা খসে পড়ে। সেখানে সুলুস লিপিতে উৎকীর্ণ সুরা আল রাহমান করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মোহাম্মদ আবদুর রহীম এ ক্যালিগ্রাফিটি করে দেন। কালো ব্যাক গ্রাউন্ডের ওপর সোনালী রংয়ের লেখা খুবই আকর্ষণীয় এবং মনোহর।

ছবি-নেট থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন