শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

কাজল দিঘীর টানে....


গ্রীষ্মের ছুটি।

হাইস্কুল ভবন আর হোস্টেল নিরব নিথর হয়ে গেছে। খেলার মাঠটা যেন আরো বেশি শুন্যতায় ছেয়ে আছে।
বিকেলে মাঠে যাই। উপলক্ষ মাঠের ওপারের একটি জানালা। না, সেখানে কোন সাড়া নেই। মধুমাস উদযাপনে সপরিবার গ্রামে গেছেন স্যারেরা।

আমার তবু ভাল লাগে একা মাঠের পাশে ঘন দুর্বাঘাসের চাদরে শুয়ে বিকেলটা কাটিয়ে দিতে। কিন্তু কত দিন আর! দু'তিন দিন পার হতেই অধৈর্য হয়ে পড়ি। প্রতিক্ষার ক্ষণ যে কত দুর্বিসহ, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

বাসায় কেন জানি বিষয়টা ফাস হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। একটা গুমট অবস্থা। অবশেষে দূরছাই বলে এক সকালে ক্যানভাসের ব্যাগটা কাধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য টুঙ্গিপাড়া পার হয়ে মধুমতির তীরে এক ছায়াঘেরা সবুজে মোড়ানো পাখি ডাকা কাজল দিঘীর গাঁও।



রূপসার ঘোলা জলে সাদা ফেনা ছড়িয়ে ফেরি এগিয়ে চলেছে। রেলিং ধরে দূরে তাকিয়ে আছি। বাতাসে চুল এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। নিমগ্নতায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে দূরাগত বাতাস কী যেন কথার আভাষ ফিসফিসিয়ে বলে গেল। আমি কি সেই কথা শুনতে পেলাম। বরিশালের মঠবাড়িয়ার কোন এক তাল-তমালে ঘেরা বাড়ির অন্দরমহলের পুকুরের শান বাধানো ঘাটে বসে আছে এলো চুলের এক কিশোরী। তার হৃদয় জুড়ে ডাহুকের একটানা আকুলি ঝরে পড়ছে। মন তার পড়ে আছে ফেলে আসা যত আবিররাঙা ঘটনায়।

নারকেল তেলের সুবাস এসে চৈতন্যে আঘাত করে। আমি ফিরে তাকাই। পাশে একদল কিশোরী হল্লা করছে। ষাট গম্বুজ আর খাঞ্জেলি দিঘী ওদের গন্তব্য। অভিভাবকেরা তাড়া দিচ্ছেন, ফেরি ঘাটে ভেড়ার সময় আচমকা ধাক্কা খেয়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সবাই শক্ত করে রেলিং ধরে যেন দাড়ায়।

এপারে আগে ট্রেন ছিল। ফকিরহাট নেমে মোল্লাহাট হয়ে বহুবার গিয়েছি। এখন ট্রেন নেই। লক্কড় মার্কা বাসে হুড়োধাক্কা খেতে খেতে মোল্লাহাট চলেছি। ফকিরহাটে রাস্তার দুপাশে পানের বরজ। সাপের মত রাস্তা। কোথাও খুব খারাপ অবস্থা। গাড়ি খাবি খেতে খেতে এগিয়ে চলছে হাটার গতিতে। ভেতরে আমরা দলাই-মলাই হচ্ছি। এরমধ্যে দেখি হুটহাট করে শিয়াল, বেজি, বনবিড়াল রাস্তা পার হয়ে জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় পাঁচ ঘন্টার এডভেন্চারে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে গেল। মোল্লাহাট গিয়ে তারপর লঞ্চে টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতি ঘাটে নামতে হবে। সেখান থেকে হাটা পথে কাজল দিঘীর গাঁও।

কপাল মন্দ। লঞ্চ ফেল করেছি।

এবার হাটা ছাড়া উপায় নেই। আমরা দল বেধে রওনা দিলাম। পথে অচেনা বাড়িতে বাড়িতে খই-গুড়-পানি খেলাম।
তিন ঘন্টার মত হাটতে হল। অবশেষে মিঠের কুল গাঁওয়ের দেখা মিলল।

বাড়িতে ঢুকতেই মামাত বোনটা দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়ল। চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলল। ওমা...দাদা এসেছে! কী মজা! কী মজা!

আনন্দের অতিশয্যে সে ভুলে গেছে যে এখন সেও বড় হয়ে গেছে। সেই কথা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তারপর আমায় আষ্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকা তার লাউলতার মত হাতদুটোর বাধন খুলে পালিয়ে গেল।

আমি হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইলাম।

চলবে-

পর্ব এক
পর্ব দুই
পর্ব তিন
পর্ব চার
পর্ব পাঁচ

ছবি-নেট থেকে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন