শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৩

হে বঙাল তব ইজ্জতে মুই পরান সপি....পর্ব এক




দিবাচা
ব্লগার আবদুল হালিমপাভেল চৌধুরী বাংলা-বাঙালী বিষয়ে ভাবনা জাগানিয়া পোস্ট দিয়েছেন।

আমার শৈশবের বঙাল স্মৃতি এসব লেখায় দেখতে পাই। বড়চাচা কলকাতা যেতেন ফুটবল খেলতে। তাকে বঙাল বলে বরাবর সেখানে ডাকা হত। হীন অর্থ তাতে বলার ভঙ্গিতে থাকলেও, আমার চাচা বঙাল পরিচয়ে গর্ববোধ করতেন। আমরা বঙাল থেকে কখন বাঙালি হইছি তা তিনি গল্পচ্ছলে বলতেন। তার সেই গল্প এখন বই-কেতাব ঘেটে বাস্তব নজির হিসেবে বেশ পাওয়া যাচ্ছে।

'ক'অক্ষর গোমাংস কিম্বা মামদো ভুত বিষয় নিয়ে শেকড় খুঁজতে শুরু করার পর নিজকে বঙাল হিসেবে সৌভাগ্যবান মনে করি।

ভাষার মাস শুরু হচ্ছে। বঙাল, বাঙ্গালা, বাংলা শব্দের ব্যবহার কখন, কোথায় এর শুরু তা খুজে দেখার একটা তাগিদ দিলের ভেতর হু হু করে ওঠে।

আবদুল হাকিম বলেছিলেন-
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

আমাদের শেকড় এতকাল খুজেছি অপাত্রে-অজায়গায় খাতকাটা লেখায়। পুথি-কেতাবের যে অমূল্য ধন-ভান্ডার হেলায় সরিয়ে রেখেছি তা এখন ধুলো ঝেড়ে ঘেটে দেখা দরকার।

উৎকল-সিতারা(উড়িষ্যার নক্ষত্র) উপাধি প্রাপ্ত আঠার শতকের কবি হাজী আবদুল মজীদ বলেন-
এক.
তার দেশ বাঙ্গালাতে মোর ঘর উড়িষ্যাতে
বালেশ্বর কটক জেলায়।
বস্তা থানার পাশ কদিমি মোকাম বাস
গড় পদ্দা পরগণা বলায়।

দুই.
কেন কি দেহাতি আমি নিরেট গাঙার।
তাহাতে আমার পয়দা দেশ উড়িষ্যার।।
বাঙ্গালায় এসে আমি ইছলামী জবান।
পড়েশুনে লিখিলাম ওহে মেহেরবান।।

মুছলিম কর্তৃত্বের আগে পূর্ব ভারতে গৌড়-বঙ্গ বঙ্গাল নামে আলাদা আলাদা ভূখন্ড সেন, বর্মন বৌদ্ধ রাজগণ শাসন করেছেন। এসব অঞ্চল প্রথম একত্রে ১৩৫২ সালে বাঙ্গালাহ বা বাঙ্গালা নামে একদেশ হয়। এর আগে দেশনাম বাঙ্গালা ছিল না।

গৌড়-বঙ্গ আজ পশ্চিম বঙ্গ আর বঙাল হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামটি প্রথম প্রকাশিত ডাকটিকেটে "বাংলা দেশ" লেখা হয়েছে।

হিন্দু-বৌদ্ধ আমলে পঞ্চ গৌড় নামে পরিচিত অঞ্চলগুলো শশাংক ও তারও আগে এটা দু'টো প্রধান ভাগে বিভক্ত ছিল। এক. বঙ্গ, দুই. বঙ্গাল। প্রাচীন শিলালিপি বা প্রত্ন ইতিহাসে এর আরো কিছু নাম ও অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। এধরণের নজির 'আরণ্যক' গ্রন্থাদি থেকে পাওয়া যায়।

১২০০ ইসাদিতে এ অঞ্চলে মুছলিম শাসন কায়েম হবার পর 'দিয়ারে লখনৌতি', 'দিয়ারে সাত গাঁও', ও 'দিয়ারে সোনার গাঁও' নামে রাজনৈতিকভাবে তিনটি মুছলিম অঞ্চল গঠিত হয়। ১৩৫২ ইসাদিতে ছোলতান হাজী শামছুদ্দিন ইলিয়াছ শাহ্ এই অঞ্চল তিনটিকে ঐক্যবদ্ধ করে "বাঙ্গালাহ" নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেন।

তারও পরে সম্রাট আকবরের আমলে এর নাম হয় "সুবা বাঙ্গালাহ"।

চলবে-

ছবি- শেখের পো'র আর্কাইভ থেকে।
-------------------------------------------------------
দিবাচা অর্থ-উপক্রমণিকা, ভূমিকা, মূখবন্ধ ইত্যাদি।

দিয়ার শব্দটি আরবি দার এর বহুবচন। অর্থ- অঞ্চল, আবাসস্থল।

সাত গাঁও শব্দটির সাত আরবি সাথিউন থেকে এসেছে। অর্থ- উপকূলীয় অঞ্চল। গাঁও শব্দটি ফারসি/আরবি, অর্থ-জনপদ।

'ক' অক্ষর গোমাংস। বঙাল এবং বাঙালা লিপির প্রতি বিদ্বেষ ও হীন অর্থে এটা চালু করা হয়। ক অক্ষরটি বাঙলা লিপির, তাই এটা গোমাংসের তূল্য, অচ্ছূৎ। এলিপি শেখা হীন কাজ। সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় এর মর্মোদ্ধার আছে। যদিও এখন একে বলা হয়- অজ্ঞ, মূর্খ, জ্ঞানহীন। অর্থাৎ বঙালরা অজ্ঞ, মূর্খ, জ্ঞানহীন!!!!!

মামদো ভূত- বিশেষ্য/বিশেষণ, বাংলাদেশের লোকবিশ্বাস অনুযায়ী প্রেতযোনিপ্রাপ্ত মুসলমান, ইসলাম ধর্মাবলম্বী ভূত (মামদো ভূত)। আরবি মহম্মদ+ঈয়। দেখুন-বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান জানুয়ারি ২০১১ পৃ-৯৭৮

বঙাল অঞ্চলে যারা হিন্দু থেকে মুসলমান হত তাদেরকে গৌড়-বঙ্গের পন্ডিতরা বলত-ওর ঘাড়ে মামদো ভূত চেপেছে বলে কটুক্তি করত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন